পেগাসাসের তালিকায় বাংলাদেশ, মন্ত্রী যা বললেন

ইসরায়েলে তৈরি হ্যাকিং সফটঅয়্যার পেগাসাস যে ৪৫টি দেশে ছড়ানোর তথ্য এসেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2021, 11:17 AM
Updated : 19 July 2021, 11:21 AM

তবে বাংলাদেশে কোনো ধরনের ‘অসঙ্গতি পাওয়া যায়নি’ মন্তব্য করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, সরকার এ বিষয়ে ‘সতর্ক রয়েছে’।

বাংলাদেশ এ ধরনের কোন সফটঅয়্যার কিনেছে কিনা জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেছেন, “এ রকম সফটঅয়্যার কেনার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টা ভালভাবে বলতে পারবে।”

এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বক্তব্য জানার কোনো চেষ্টা এখন পর্যন্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম করেনি।

বলা হচ্ছে, কোনো বেসরকারি কোম্পানির তৈরি করা সবচেয়ে শক্তিশালী স্পাইওয়্যার হল এই পেগাসাস। ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপ এই নজরদারি সফটওয়্যার তৈরি করেছে এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে তা বিক্রি করেছে।

এই হ্যাকিং সফটঅয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকার মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিকদের ফোনে নজরদারি চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।

ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানসহ ১৬টি সংবাদপত্র হ্যাকিংয়ের এই ঘটনা ফাঁস করার পর এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে আলোচনা।

এই হ্যাকিংয়ের লক্ষ্যবস্তের তালিকায় ভারতের অন্তত ৩০০ রাজনীতিক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিজ্ঞানীর নাম থাকার কথা জানিয়েছে দেশটির নিউজ পোর্টাল দ্য অয়্যার। তবে ভারত সরকার এই আড়িপাতায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ফাঁস হওয়া একটি ডেটাবেইসে এই ফোন নম্বরগুলো প্রথমে পায় প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পরে তারা গার্ডিয়ান, দ্য অয়্যারসহ ১৬টি সংবাদ মাধ্যমকে তা জানায়। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’।

পেগাসাস নামের এই স্পাইওয়্যার আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর মেসেজ, ছবি, ইমেইল পাচার করতে যেমন সক্ষম, তেমনি কল রেকর্ড এবং মালিকের অগচোরে গোপনে তার ভিডিও করা বা মাইক্রোফোন চালু করে কথোপকথনও রেকর্ড করতে পারে।

কোন কোন দেশের সরকার পেগাসাস কিনেছে, গোপনীয়তার শর্তের অজুহাতে সে তথ্য এনএসও প্রকাশ করেনি। তবে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সিটিজেন ল্যাবের গবেষণায় অন্তত ৪৫টি দেশে পেগাসাসাস ছড়ানোর প্রমাণ মেলার কথা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।

দেশগুলো হল: আলজেরিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, মিশর, ফ্রান্স, গ্রিস, ভারত, ইরাক, ইসরায়েল, আইভরি কোস্ট, জর্ডান, কাজাখস্তান, কেনিয়া, কুয়েত, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লেবানন, লিবিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, ওমান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন অঞ্চল, পোল্যান্ড, কাতার, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, টোগো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া।

ওয়াশিংটন পোস্ট অবশ্য লিখেছে, কোনো দেশে কোনো ফোন পেগাসাসের কবলে পড়েছে মানেই যে ওই দেশের সরকার ওই স্পাইওয়্যারের ক্রেতা, তেমন নাও হতে পারে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সবই চেক করেছি এবং সতর্ক রয়েছি। কোনো রকম অসঙ্গতি দেখতে পাইনি। এখানে আপাতত ভয়ের কোনো কারণ নেই। অনেক সময় এসব বিষয়ে গুজবও ছড়ানো হয়। আমাদের সব নেটওয়ার্ক খোঁজ নিয়েছি, তবে কোনো সমস্যা এখনো দেখা যায়নি।”

কানাডার সিটিজেন ল্যাব তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, এ পর্যন্ত ৩৬টি পেগাসাস সিস্টেম তারা শনাক্ত করতে পেরেছে, যারা প্রত্যেকের এক একটি অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। এই ৩৬টি পেগাসাস সিস্টেম থেকে ৪৫টি দেশে নজরদারি চালানো হয়েছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। এর অন্তত দশটি অপারেট তাদের নজরদারি তৎপরতা চালিয়েছে অন্য দেশেও।

সিটিজেন ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী, গঙ্গা নামের একটি অপারেটর ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, হংকং, ভারত ও পাকিস্তানে নজরদারি চালিয়ে আসছে।

এসব দেশে পেগাসাসের সম্ভব্য আক্রমণের শিকার ১২টি নেটওয়ার্কের নামও সিটিজেন ল্যাব প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ সংস্থা টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) নামও রয়েছে।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল মতিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের নেটওয়ার্কে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা যায়নি। আমরা সব সময় নজরদারিতে রেখেছি। এ ধরনের সমস্যা হলে অবশ্যই আমাদের নজরে আসবে এবং তার আগেই আমরা চিহ্নিত করতে পারব।”

কারিগরিভাবে পেগাসাস কীভাবে করে কাজ করে, কোনো ফোনে আক্রমণ করার পর সেখানে কী ধরনের চিহ্ন থেকে যায়, তা বোঝার জন্য কাজ করেছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্লিন ভিত্তিক সিকিউরিটি ল্যাবের গবেষক ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি।

তাকে উদ্ধৃত করে গার্ডিয়ান লিখেছে, “যদি কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস সফটঅয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে।

“ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে।”

গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া ডেটাবেইসে ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহক এদের বিষয়ে তৎপর ছিল।

এনএসও দাবি করেছি, তারা সরকারি কোনো সংস্থার কাছে সফটঅয়্যারটি বিক্রির পর তার পরিচালনার দায়িত্বে আর থাকে না, ফলে গ্রাহকের লক্ষ্যবস্তুর বিষয়ক কোনো তথ্যও তাদের হাতে আসে না।

বাংলাদেশের প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলছেন, পেগাসাস এতটাই শক্তিশালী একটি স্পাইওয়্যার, যে আক্রান্ত হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থাকে না বললেই চলে।

এই হ্যাকিং সফটওয়্যার থেকে ব্যক্তিগতভাবে রক্ষা পাওয়ার কোনো ‘উপায় নেই’ জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সুমন বলেন, “কেউ যদি মনে করে তার ডিভাইস এ স্পাইওয়্যার দিয়ে আক্রান্ত হয়েছে, তার সাময়িক সমাধান হতে পারে পুরো ডিভাইসটি ফ্ল্যাস বা ফরমেট করে আবার ব্যবহার করা। তবে ফরমেট করার পরপরই সে যে আবার আক্রান্ত হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

কেউ বা কোন দেশ ইচ্ছা করলেই এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, তা মনে করাও ‘কঠিন’ বলে মন্তব্য করেন সুমন।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “সাইবার জগতে সব সময় নিরাপদ থাকতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। আজ পেগাসাস নামে স্পাইওয়্যার আলোচনায় এসেছে, কয়েকদিন বাদে হয়ত আরেকটি বিষয় সামনে আসবে। আমাদের বিডিসার্ট (কম্পিউটার ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম ফর বাংলাদেশ) অন্যান্য দেশের সাথে এসব বিষয়ে তথ্য আদান প্রদান করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।”