তারা বলছেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত দেড়শ বছরের পুরনো আইনে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা রয়েছে তা খুবই সংকীর্ণ। সেটাকে যুগোপযোগী করে তার পরিধি বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রেইপের সংজ্ঞাটা আমরা পরিবর্তন করার কথা বলেছি। মানুষ নানাভাবে যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে হবে।”
গত জানুয়ারিতে রাজধানীর কলাবাগানে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা হয়। ফরেনসিক পরীক্ষায় মেয়েটির যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথে ক্ষত চিহ্ন পাওয়া যায়। ‘অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে’ তার মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনার কথা তুলে ধরে অধিকারকর্মী মালেকা বানু বলেন, কিছু দিন আগে ধানমণ্ডিতে যে ঘটনা ঘটলো, সেখানে ‘এক্সটার্নাল অবজেক্ট’ ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো আইনেই এটাকে ধর্ষণ বা অপরাধ হিসেবে বলা নেই।
ধর্ষণের সংজ্ঞার পরিধি বাড়ানোর কথা বলতে গিয়ে গত বছর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরেন ‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের’ নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক।
তিনি বলেন, “বেগমগঞ্জে যে ঘটনা ঘটেছে সেখানে রেইপ বলছে না। দেখা গেছে, নারীর যৌনাঙ্গে বাঁশ ঢুকিয়েছে, হাত দিয়েছে। যেহেতু পুরুষাঙ্গ দিয়ে ‘পেনিট্রেশন’ ছিল না সেজন্য রেইপ বলছে না। এরকম খণ্ডিত করলে শাস্তি কম হয়।
“নির্যাতন ঠিকই করছে তবে অন্যভাবে করছে। শুধুমাত্র পুরুষাঙ্গ দিয়ে কিছু করছে না বলে রেইপ হচ্ছে না। সেজন্য সংজ্ঞা আর বিস্তৃত করতে হবে।”
অপরাধ বিষয়ক মৌলিক আইন ১৮৬০ সালের দণ্ড বিধি আইনে স্ত্রী ছাড়া অন্য নারীর সঙ্গে তার অসম্মতিতে ও ১৪ বছরের কম বয়সী মেয়ের সঙ্গে যৌন সঙ্গমকে (rape) ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আর যৌন সঙ্গমের জন্য ‘পুরুষের লিঙ্গ প্রবেশকে’ যথেষ্ট ধরা হয়েছে।
আইনজীবী ফওজিয়া করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ম্যারিটাল রেইপ (বৈবাহিক ধর্ষণ) নিয়ে আমাদের আইনে তেমন করে কিছু বলা নেই। এটাতো বড় একটা জায়গা। আসলে গবেষণা করে এগুলো পরিবর্তন করতে হবে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, এমন এক সংজ্ঞা আনতে হবে ধর্ষণের, যেটাতে কোনো বৈষম্য থাকবে না। যাতে যে কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলে যেন আইনের আওতায় বিচার চাইতে পারেন।
“বিদ্যমান ধর্ষণের সংজ্ঞায় পুরুষ ধর্ষণ করতে পারে এবং নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হতে পারে। অর্থাৎ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ বা হিজড়া যদি ধর্ষণের শিকার হন তাহলে তারা সংজ্ঞার বাইরে চলে যাচ্ছেন।”
সেক্ষেত্রে ‘অস্বাভাবিক যৌন সঙ্গম’ বিষয়ক দণ্ড বিধির ৩৭৭ ধারার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তাদের বিচার পাওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই।
গত বছর সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় আগের মতই দণ্ডবিধিতে দেওয়া সংজ্ঞা বহাল রাখা হয়েছে।
দেড় শতক বছর আগে ব্রিটিশদের তৈরি দণ্ডবিধিতে দেওয়া ধর্ষণের সেই সংজ্ঞা কিন্তু আধুনিক বৃটেনে অচল। এবিষয়ে যুক্তরাজ্যের যে আইন রয়েছে, তা ২০০৩ সালে প্রণীত‘সেক্সুয়াল অফেন্স অ্যাক্ট’ বা যৌন অপরাধ আইন। সেখানে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা লিঙ্গ নির্বিশেষ। তাতে ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার ব্যাখ্যায় 'কারও অসম্মতিতে তার যোনিতে বা পায়ুপথে বা মুখে লিঙ্গ প্রবেশকে' বুঝানো হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রণীত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের শিকার হিসেবে মেয়ে-ছেলে নির্বিশেষে ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুকে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে দণ্ডবিধিতে দেওয়া ধর্ষণের সংজ্ঞা বহাল রাখায় বড় অসঙ্গতি রয়ে গেছে।
তবে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারার বিধানসাপেক্ষে’ দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় উল্লেখিত ‘রেইপ’ এর সংজ্ঞার আওতায় ছেলে শিশুরাও পড়ে বলে মনে মনে করেন ব্লাস্টের গবেষক তাকবীর।
এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় বলা আছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’
“আর আইনে শিশুর সংজ্ঞায় বলা আছে, শিশু অর্থ অনধিক ষোল বছর বয়সের কোনো ব্যক্তি। এইখানে ১৬ বছরের নীচে সকল ব্যক্তি চলে আসে। আর ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলাই আছে, আইনের ৯ ধারার বিধানসাপেক্ষে ওই সংজ্ঞা।”
তাকবির মনে করেন, বাংলাদেশে ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হলেও অজ্ঞতার কারণে ৩৭৭ ধারায় মামলা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে ১৬ বছরের কম যে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে ওই আইনে সে বিচার চাইতে পারে।
“মাদ্রাসার কেইসের ক্ষেত্রে ৩৭৭ ধারায় মামলা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। পুলিশকে আমরা বোঝাতে পারছি না।”
“দুটোই বিশেষ আইন। বিশেষ আইন সবসময় সাধারণ আইনের ওপর প্রাধান্য পায়। যদি কোন সংঘর্ষ তৈরি হয়। যখন দুটো বিশেষ আইনের মধ্যে সংঘর্ষ হয় তখন কী হবে? ”
এক্ষেত্রে মেয়ে শিশুর বয়স নিয়ে আইনে মধ্যে অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে জিনাত আরা হক বলেন, “মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮। কিন্তু সেক্সুয়াল রিলেশন করতে পারবে, মানে সম্মতি দিতে পারবে ১৬ বছরে।
“কিন্তু দণ্ড বিধিতে বিবাহিত হলে ১৪ বছর হলেই যৌন সম্পর্ক করতে পারবে। তাহলে কী হলো ব্যাপারটা? ১৪ বছরে তো বিয়েই করতে পারে না। কিন্তু এটা আবার আইনে বৈধ। এই বিষয়গুলো বিভ্রান্তিকর।”
বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৬ বছরের নিচে কোনো মেয়ের সম্মতি নিয়ে যৌন সম্পর্ক গড়লেও তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হয়। আবার দেশে ১৮ বছরের নিচের বয়সীরা শিশু হিসেবে আইনিভাবে স্বীকৃত।
সাক্ষীর সুরক্ষা ও আর্থিক সুবিধা
ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষীর সুরক্ষার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন আইনজীবী তাকবীর।
তিনি বলেন, যে কোনো অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রেই সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে অপরাধের শিকার ব্যক্তির ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে না।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১৫৫(৪) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যখন ‘বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার’ অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে ‘দুশ্চরিত্রা’।
সেই প্রসঙ্গ টেনে তাকবীর বলেন “কাউকে দুশ্চরিত্র বলা থেকে রেহাই দিলেন, তাতে আদালতে তার মান থাকল। আদালতে পৌঁছানোর আগে পুলিশ স্টেশনে যে হয়রানি হয় ওখানে? এসব জায়গায় বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন।"
এজন্য সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, শুধু ধর্ষণ নয়, যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রেই এটা কার্যকর হবে।
“আর একটা বিষয়, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধের শিকার হওয়ার সাথে সাথে কিছু আর্থিক সুবিধা প্রয়োজন হয়। সেজন্য এই প্রতিকারটা দরকার। মধ্যম আয়ের দেশ বলেই এই দাবি আমরা করতে পারি।”
আলামত সংরক্ষণ
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির আলামত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়াকে টেকসই ও যুগোপযোগী করার উপর জোর দেন জিনাত আরা হক।
তিনি বলেন, “ইউএসএতে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আলামত নিতে পারে- সোয়াব বা অন্য যা আছে। আমাদের দেশে এই মেকানিজমগুলো নেই। আলামত নেওয়ার পদ্ধতি যুগোপযোগী নয়।”
পুরনো আইনের সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন করা জরুরি মন্তব্য করে ফওজিয়া করিম বলেন, “আমাদের আইনের পরিবর্তন প্রচুর দরকার। পেনাল কোড যখন হয়েছিল, আর এখনকার সময়ের মধ্যে অনেক ফারাক।”
“বিশেষ করে এভিডেন্স বিষয়ে। ধরুন, পারিবারিক মামলায় স্ত্রী অনেক সময় সহিংসতা করছে বা স্বামী করছে। এগুলো অনেকে রেকর্ড করে।
আইনের এসব সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচাপরপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, আইন কমিশন শিশুর বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
“আশা করছি, আগামী তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে দেব। যেই খসড়াটি আমরা করছি, সেখানে শিশুর ওপর সকল ধরনের নির্যাতনকে আমরা অ্যাড্রেস করেছি।”
বিষয়গুলো নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।