কোভিড: সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী রেখায় বিপদের ছায়া

সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন জেলায় কোভিডের বিস্তারের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্তের হার ফের বাড়তে বাড়তে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে মহামারী শোচনীয় পরিস্থিতির দিকে মোড় নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন এক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2021, 06:52 PM
Updated : 23 June 2021, 07:41 PM

বুধবার একদিনে কোভিডের নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা ঠিক সাত দিন আগে ১৫ শতাশের কিছুটা বেশি ছিল।

গত বছর মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর গত ১৫ মাসে পরীক্ষার বিপরীতে গড় শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত নয় দিন ধরেই দৈনিক শনাক্তের হার তার চেয়ে বেশি থাকছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫৫৪টি ল্যাবে ২৮ হাজার ২৫৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

তাতে সংক্রমণ ধরা পড়েছে ৫ হাজার ৭২৭ জনের মধ্যে, যা আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার দাঁড়াচ্ছে ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

এমন পরিস্থিতিতে চলাচলে জনসাধারণকে বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন।

বুধবার কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে তিনি বলেন, প্রতিদিন পজিটিভ রোগীর সংখ্যার সঙ্গে মৃত্যুও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এ কারণেই ঢাকার চারপাশে কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে লকডাউন দেওয়ায় জীবনযাত্রায় কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে।

“কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলা করা, হাসপাতালের প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দেওয়া এবং মৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য সবাইকেই সহযোগিতা করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে কোভিড পরিস্থিতি শোচনীয় অবস্থায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী ভারত থেকে দেশের সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় সামনে বিপদ রয়েছে।

পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ খুলনা বিভাগে। সেখানে দৈনিক শনাক্তের এই হার থাকছে ৪০ শতাংশের বেশি; রাজশাহীতে থাকছে ২০ শতাংশের কাছকাছি।

গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর ৬ এপ্রিল দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার ৫ শতাংশের ওপরে উঠে গিয়েছিল। মের শেষ দিক থেকে অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা ২০ শতাংশের উপরেই থাকে। এর মধ্যে ১২ জুলাই তা ৩৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশে পৌঁছায়, যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

সংক্রমণের প্রথম ঢেউ সামলে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিনশর ঘরে নেমে এসেছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় দুই মাস দৈনিক শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী, পরপর দুই সপ্তাহ শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। সে কারণে বিশেষজ্ঞরাও তখন আশা দেখতে শুরু করেছিলেন।

কিন্তু মার্চে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করলে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যায়। এপ্রিলের ১৬ দিনে এক লাখ মানুষের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। ৭ এপ্রিল রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। ১৫ দিনেই এক হাজার কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু ঘটে, ১৯ এপ্রিল রেকর্ড ১১২ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ওই সময়টাকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সেই ঢেউয়ের ধাক্কায় যেমন দ্রুত গতিতে শনাক্ত ও মৃত্যুর গ্রাফ উঁচু থেকে উঁচুতে উঠছিল, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একই রকম দ্রুততায় তা নেমে আসতে শুরু করে।

মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মোটামুটি দুই সপ্তাহ দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দেড় হাজারের ভেতরেই ওঠানামা করছিল। তাতে সরকারের মন্ত্রীরাও দ্বিতীয় ঢেউ সামলে ওঠার কথা বলতে শুরু করেছিলেন।

কিন্তু জুনের শুরু থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগী আবার বাড়ছে। দেড় মাস পর গত সোমবার দেশে আবারও এক দিনে তিন হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের খবর আসে।

মে মাসের শুরুতেই ভারত থেকে আসা তিন বাংলাদেশির দেহে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ডেল্টা শনাক্ত করা হয়। এরপর রাজশাহী ও খুলনার ভারত সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।

জুনের শুরুতে রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণায় সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর জানায়, দেশে করোনাভাইরাসের ধরনটির সামাজিক বিস্তার বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেছে।

সংক্রমণের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঢাকার পরিস্থিতিই সবচেয়ে খারাপ ছিল। কিন্তু ডেল্টা ধরন ছড়াতে শুরু করার পর এখন উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে।

সংক্রমণ বাড়ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট বিভাগেও। আর খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ বিভাগেহ সংক্রমণ কিছুটা কমেছে।

ঢাকা নগরীসহ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বাধিক ২০৬৪ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী জেলায় ৩৫২ জন, খুলনা জেলায় ৩০৫ জন, যশোরে ১২১ জন, ঝিনাইদহে ১১৭ জন, কুষ্টিয়ায় ১২২ জন, চট্টগ্রাম জেলায় ২৩৬ জন, কক্সবাজারে ১০৭ জন, নোয়াখালীতে ১১৫ জন, টাঙ্গাইলে ১৪৯ জন, ফরিদপুরে ২১২ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১১১ জন, নাটোরে ১০২ জন, এবং দিনাজপুরে ১৪১ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে গত এক দিনে।

করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে ‘লকডাউন’ না দেওয়ায় ভাইরাসের ‘বীজ বপন’ করা হয়েছিল মন্তব্য করেছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা ডা. বে-নজির আহমেদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। কারণ ভারত থেকে যে ডেল্টা ধরন আসলো, তা আমরা লালন-পালন করলাম সীমান্তের জেলাগুলোয়। আরও বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে দিলাম।

“যখন ২০-২৫টা রোগী ধরা পড়েছে, তখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিলে সেখানেও ছড়াত না। যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে লকডাউন দিলে ভাইরাস অন্য জেলায় ছড়াত না।”

সামনে পরিস্থিতি আরও ‘খারাপের দিকে যাবে’ বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক।

তিনি বলেন, “আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করা, কোয়ারেন্টিন করা, সন্দেহভাজনদের খুঁজে বের করে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা না নেওয়ায় জানা যাচ্ছে না কে আক্রান্ত, কার মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।

“এ বিষয়টি যদি না জানা থাকে তাহলে তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা নিচ্ছে তা অকার্যকর। তাতে ছড়ানোটা অনিবার্য।”