নারী কর্মকর্তায় আপত্তির বিষয়টি ‘বিস্তারিত দেখবে’ সরকার

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের বাদ রাখতে সংসদীয় একটি কমিটির সুপারিশ ‘বিস্তারিত’ জেনে দেখবেন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2021, 12:28 PM
Updated : 14 June 2021, 12:28 PM

সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে একথা জানান।

সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় সংশ্লিষ্ট জেলা/উপজেলা প্রশাসন। ডিসি বা ইউএনও সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে থাকেন। কফিনে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

অনেক স্থানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে নারী কর্মকর্তারা রয়েছেন, আর সেখানেই আপত্তি তুলেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

রোববার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এনিয়ে আলোচনা ওঠার পর সরকারের কাছে সুপারিশ রাখা হয়েছে গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুঁজতে।

এ বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেবে কি না- জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “খবরে দেখেছি। আপনি কী মনে করেন? কী বলেছেন, তা জানতে হবে। “

এরপর প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি একজন সাংবাদিক মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে পড়ে শোনান।

তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “এটা তো সামারি বললেন। মিটিংয়ে কী বলেছেন, সেটা দেখতে হবে। অনেক সময় কোর্টে কোনো পক্ষ হাই কোর্টের রুলিং দেখিয়ে বলেন, রুটিংয়ে এটা আছে, পড়ে শোনাতে বলার পর দেখা যায় ইম্লিকেশনটা উল্টো।”

এরপর কুরআন-হাদিসের কিছু বিষয় তুলে ধরে সেগুলো উল্টোভাবে বিশ্লেষণ করা যায় বলে উদাহরণ তুলে ধরেন খোন্দকার আনোয়ারুল।

তিনি বলেন, “হাদিসে যেসব রয়েছে অনেক সময় ইম্লিকেশন উল্টো হয়। রাষ্ট্র যে আদেশ দেবে, সেটা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। কল্যাণকর যদি আদেশ দেয়, সেটা মেনে চলতে হবে।”

“আমাকে জানতে হবে। গার্ড অব অনার নিয়ে কেন বলেছেন, জানি না। ধর্মীয় বিধান নিয়ে যদি বলত, তাহলে বলা যেত। লেট আস সি,” বলেন তিনি।

‘মৌলবাদের সাপকে বের করতে চাওয়া’

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের বাদ রাখতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তা ‘মৌলবাদের বিষধর সাপকে গর্ত থেকে বের করতে চাওয়া’ বলে মন্তব্য এসেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি থেকে।

সোমবার কমিটির কেন্দ্রীয় ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বিবৃতিতে সংসদীয় কমিটির এ প্রস্তাবের বিষয়ে ‘ক্ষোভ ও নিন্দা’ও জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, “গণমাধ্যমে এ বিষয়ে জানতে পেরে আমরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নারীর মর্যাদা ও সমঅধিকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ মর্যাদার জন্য যে সব কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

“মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি ধর্মের দোহাই দিয়ে কীভাবে এ ধরনের নারীবিদ্বেষী, মানবাধিকারবিরোধী, সংবিধানবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সুপারিশ করতে পারে তা আমাদের বোধের অতীত। আমরা এই ন্যক্কারজনক প্রস্তাবের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জ্ঞাপন করছি।”

জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামসহ ‘জঙ্গি মৌলবাদী কোনো ওয়াহাবী, সালাফী, মওদুদীবাদী সংগঠন’ আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছে ইসলামের দোহাই দিয়ে এ ধরনের দাবি জানায়নি উল্লেখ করে নির্মূল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়, “তারা নারী নেতৃত্ব হারাম বলে ফতোয়া দিলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা মেনে নিয়েছে।

“সংসদীয় কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের জানাজার গার্ড অব অনারে নারীদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে আপত্তি করে মৌলবাদের যে বিষধর সাপকে গর্ত থেকে বের করে আনতে চাইছে- এর পরিণতি বর্তমান সরকার, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতির জন্য ভয়াবহ হবে।”

অবিলম্বে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ প্রত্যাহার এবং এ ধরনের ‘নিন্দনীয় আচরণের’ জন্য সংশ্লিষ্টদের দুঃখ প্রকাশের দাবি জানিয়ে সুপারিশ প্রত্যাহারের আহ্বান করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

বাম দলগুলোর প্রতিবাদ

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে করে ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দাবি জানিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির নারী সেল।

সিপিবি নারী সেলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লুনা নূর স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, “যারা এ প্রস্তাব করেছে, তারা বাংলাদেশের সংবিধানকে লঙ্ঘন করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি অবস্থান নিয়েছে।”

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “এ ধরনের প্রস্তাব করা এক ধরনের ধৃষ্টতা দেখানো। কোনোভাবেই বাংলাদেশের নারী সমাজ ও আপামর জনগণ এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে না।”

একই বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি রওশন আরা রুশো এবং সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসুর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “সংসদীয় কমিটির এ প্রস্তাব নারীর জন্য অবমাননাকর শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংবিধানবিরোধী।

“গার্ড অব অনার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের সম্মান প্রদর্শনের একটি রীতি, কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কার্যকলাপ নয়।”

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের নিয়ে আপত্তি জানানোর বিষয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার।

তাদের যৌথ এক বিবৃতিতে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এ বক্তব্য সংবিধানবিরোধী, চরম নারীবিদ্বেষী, বৈষম্যমূলক ও কুৎসিত।

“এ কুৎসিত বক্তব্যের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর নারীবিদ্বেষী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।”