ধর্ষণের অভিযোগে শিশু গ্রেপ্তার: ওসিসহ সাত পুলিশকে বরখাস্তের নির্দেশ

বরিশালের বাকেরগঞ্জে ধর্ষণের অভিযোগে চার শিশু গ্রেপ্তারের মামলা অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাই কোর্ট ওসিসহ সাত পুলিশ সদস্য ও সমাজসেবার প্রবেশন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং বিচারিক হাকিমের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2021, 03:28 PM
Updated : 13 June 2021, 08:59 PM

রোববার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লার ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেয়।

গত বছর ধর্ষণের অভিযোগে ৯ থেকে ১১ বছর বয়সী এই চার শিশুর বিরুদ্ধে নেওয়া ফৌজদারি ব্যবস্থার বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে রোববার উচ্চ আদালত থেকে এই রায় আসে।

আদালত একই সঙ্গে শিশু আইন অনুযায়ী শিশুবান্ধব পুলিশ কর্মকর্তা, শিশু কল্যাণ ডেস্ক ও শিশু বিষয়ক কল্যাণ কর্মকর্তার (সিএপিও) দায়িত্ব এবং বাধ্যবাধকতা বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করে দেশের সব থানায় সরবরাহ করতে স্বরাষ্ট্র ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে।

বাকেরগঞ্জে গত বছর ৬ অক্টোবর ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে চার শিশুকে আসামি করে এই মামলা করা হয়। ওই দিনই চার শিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পরদিন ৭ অক্টোবর বরিশালের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এনায়েত উল্লাহ এক আদেশে চার শিশুকে যশোর পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেয়।

রোববার মামলাটি অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া রায়ে হাই কোর্ট আইন অমান্য করে শিশুদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা (ধর্ষণের মামলা দেওয়া) গ্রহণে যুক্ত বাকেরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), দুই উপপরিদর্শক (এসআই) এবং শিশুদের গ্রেপ্তারের সঙ্গে যুক্ত চার পুলিশ সদস্যসহ মোট সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উচ্চ আদালত স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে এই নির্দেশ দিয়েছে।

একই সঙ্গে চার শিশুর ক্ষেত্রে এখতিয়ার বহির্ভূত আদেশ দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিমের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করতে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রায়ে আদালত সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে দেওয়ানি বিচারিক ক্ষমতায় যুক্ত করতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে।

তাছাড়া আইন অনুযায়ী যথাযথ দায়িত্ব পালন না করায় বরিশালের সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সমাজসেবা অধিপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে রুল শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল গোলাম সারোয়ার পায়েল।

এছাড়া শিশু অধিকার সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ও আইনি সহায়তাকারী সংগঠন ব্লাস্টের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. আব্দুল হালিম। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী জামিউল হক ফয়সাল।

আব্দুল হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চার শিশুকে গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে মামলায় আদালত কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছেন।

“রায়ে আদালত শিশুদের গ্রেপ্তার, আটক রাখা ও তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ধর্ষণের মামলাটি অবৈধ ঘোষণা করেছেন।” 

এটিকে মাইলফলক রায় হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার পর রুল শুনানিতে আমরা দেখিয়েছি বিচারিক কর্মকর্তা এবং পুলিশ কিভাবে শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করেছে, কিভাবে শিশু আইনের একাধিক ধারার লঙ্ঘন করেছে। তারই প্রেক্ষিতে আজকে এই মাইলফলক রায় হল।”

চার শিশুর বয়স ৯ থেকে ১১ বছরের মধ্যে জানিয়ে আইনজীবী হালিম বলেন, “এই চার শিশুর প্রকৃত বয়স কত সেটা নির্ণয় করার দায়িত্ব ছিল থানার শিশুবান্ধব কর্মকর্তার।

“প্রবেশন কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল তাদের দেখভাল করার। এর কোনোটাই তারা করেননি। শিশু আইন অনুযায়ী বিচারিক হাকিমের তো কোনো এখতিয়ারই ছিল না।”

এসব কারণে আদালত তাদের বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে মামলাটি চলমান (কন্টিনিউয়াস মেন্ডামাস) রাখা হয়েছে বলেও জানান এই আইনজীবী।  

বিচারিক হাকিমের বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “আদালত বলেছেন, তিনি আইন না পড়ে এবং শিশু আদালতের (জেলা জজের) সাথে পরামর্শ না করে অথবা পরামর্শ না নিয়ে তিনি যে বিচারিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটি কেবল তার অধিক্ষেত্রের বাইরেই নয়, বেআইনিও।

“এই কারণে তিনি যে এই আদালতে (হাই কোর্টে) নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার এই নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে বিচারিক কর্মকর্তারা এই ধরনের এখতিয়ারবহির্ভূত, বেআইনি সিদ্ধান্ত নিতেই থাকবেন।”

আইনজীবি হালিম বলেন, “পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, শিশু আইনকে অমান্য করে, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা নিরীহ নিরাপরাধ শিশুদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় যেভাবে ব্যবহার করছে, তা কেবল আইনের লঙ্ঘনই নয়- একই সঙ্গে তা শিশুদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।

“ফলে এই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ না করা হয়, তাহলে তারা ক্রমাগতভাবে শিশুদের লঙ্ঘন করে চলবে।”

“প্রবেশন কর্মকর্তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, স্পর্শকাতর একটি দায়িত্বে থেকে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে তিনি তার দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা দেখিয়েছেন”, যোগ করেন তিনি।      

মামলার ঘটনাক্রম

গত বছর ৬ অক্টোবর ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে তার বাবা এই চার শিশুকে আসামি করে মামলা করলে বাকেরগঞ্জ থানা পুলিশ ওই দিনই তাদের গ্রেপ্তার করে।

পরদিন ৭ অক্টোবর বরিশালের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এনায়েত উল্লাহ আদেশে চার শিশুকে যশোর পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

এ নিয়ে একটি টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদন ৮ অক্টোবর রাতে নজরে আসার পর তাৎক্ষণিকভাবে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেয় উচ্চ আদালত।

আদেশে ওই রাতেই চার শিশুর জামিনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বরিশালের শিশু আদালতের বিচারককে নির্দেশ দেওয়া হয়।

পাশপাশি চার শিশুকে তাদের অভিভবাকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত।

এছাড়া ওই চার শিশু ও তাদের অভিভাবকসহ বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এনায়েত উল্লাহকে সশরীরে হাই কোর্টে হাজির থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

মামলার এজাহারে যে চার শিশুকে আসামি করা হয়েছে, কেন তাদের এই আদালতের (হাই কোর্টের সামেনে) সামনে আনা হবে না এবং এই শিশুদের বিরুদ্ধে মামলাসহ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

এই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।

উচ্চ আদালতের এই আদেশের পর ওই রাতেই চার শিশুকে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দেয় বরিশালের আদালত।

পরদিন ৯ অক্টোবর সকালেই চার শিশুকে তাদের বাড়িতে অভিভাবকের কাছে পৌঁছে দেয় প্রশাসন।

এরপর নির্দেশ অনুযায়ী গত বছর ১১ অক্টোবর চার শিশু ও তাদের অভিভাবক, বরিশোলের বিচারিক হাকিম এনায়েত উল্লাহ, বাকেরগঞ্জ থানার ওসি আবুল কালাম, বরিশালের সমাজসেবা প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ ও বাকেরগঞ্জ থানার শিশু বিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা এস আই বশির উদ্দিন হাই কোর্টে হাজির হয়।

আদালত সেদিন চার শিশু ও তাদের অভিভাবকসহ প্রত্যেকের বক্তব্য শুনে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে তাদের পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেয়।

এরপর এই মামলা পক্ষভুক্ত হতে আবেদন করে শিশু অধিকার সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ও আইনি সহায়তাকারী সংগঠন ব্লাস্ট।

আদালত দুটি সংগঠনকে পক্ষভুক্ত করে রুল শুনানির পর রোববার রায় দিল।