বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে সোমবার দুপুরে পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি জোরে জোরেই। বলছিলেন, “এই কয়টা দিন যে কী কষ্টে আছিলাম। আইজকা তেমন যাত্রী হয়নি, আড়াই হাজারের মতো পাইছি।“
দীর্ঘ লকডাউনের পর বাস নিয়ে আবার সড়কে নামা চালক ও পরিবহনকর্মীদের প্রায় সবাই আবার কাজে ফিরে আসার আনন্দের কথা বললেন।
আয়-রোজগার না থাকায় আর্থিক অনটনে দিন কাটানোর হতাশাও লুকালেন না কেউ কেউ।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোববার থেকে আবার দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল শুরু হওয়ায় ছিদ্দিকের মত চালক এবং অন্য পরিবহন কর্মীরা ফিরতে শুরু করেছেন; এতে সুনসান টার্মিনালগুলো আবার জেগে উঠতে শুরু করেছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর বিস্তার রোধে গত ৫ এপ্রিল লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই বন্ধ ছিল দূরপাল্লার বাস চলাচল। রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাসটার্মিনালগুলো এরপর থেকেই একরকম জনশূন্য হয়ে পড়ে।
তবে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের জন্য দীর্ঘ লকডাউন দেওয়া হলেও বাস চলাচলের দ্বিতীয় দিনেও অনেকের মধ্যে সেই সচেতনতা দেখা যায়নি।
গাবতলী কিংবা মহাখালী দুই টার্মিনালেই বাসের কর্মী, কাউন্টারের কর্মী ও মেরামতকারীদের বেশিরভাগকে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। যাত্রীদের বেশিরভাগের মুখে অবশ্য মাস্ক ছিল।
সোমবার দুপুরে মহাখালীতে গিয়ে শোনা গেল পুরনো সেই চিরচেনা হাঁকডাক- ‘জামালপুর, মুমনসিং, নেত্রকোণা, কেন্দুয়া, হালুয়াঘাট’ ইত্যাদি নানা গন্তব্য ধরে ডাকছেন বাসকর্মীরা।
কিছু বাসও ঢুকছে হর্ন বাজিয়ে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তা যেন একটু বেশিই কানে বাজল।
টার্মিানলের ভেতরে যেতেই শোনা গেল গাড়ি মেরামতের ‘টুংটাং’ শব্দ। কারও ব্যাটারি ‘বসে গেছে’, কারও গাড়ির ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না, কোনো গাড়ির ইলেকট্রিক লাইনে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এনা পরিবহনের বাস চালক মো. শামীম সকালেই সিলেট থেকে ট্রিপ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন বাস না চলায় ব্রেকে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। ‘বাকেট’ পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাকে।
টার্মিনালের ভেতরে কাউন্টারগুলোও ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে।
বগুড়া-নওগাঁ রুটের একতা পরিবহনের কাউন্টারে দেখা গেল নতুন ভাড়ার তালিকা লাগাচ্ছেন একজন কর্মী। বগুড়া ৫৮০, নওগাঁ ৭২০ টাকা করে ভাড়া।
কাউন্টার মাস্টার দ্বীন ইসলাম বলেন, সকাল থেকে কয়েকটা ট্রিপ গেছে। সকালের দিকে ভালো যাত্রীই ছিল। প্রতি বাসে ২০ জন করে যাত্রী দেওয়া হচ্ছে।
এনা পরিবহনের সুপারভাইজার মো. নোমান বলেন, এখন ময়মনসিংহের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩৫০ টাকা করে, যা আগে ছিল ২২০ টাকা। সকালে ফুল বুকিং নিয়ে এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে।
এই টার্মিনালের পরিবহনকর্মীরা জানালেন, লকডাউনে বেশিরভাগ বাসই বসা ছিল। শুধু ঈদের সময় কিছু বাস ‘কাউন্টার রিজার্ভে’ উত্তরাঞ্চলের পথে চলাচল করেছে।
শুধু পরিবহনকর্মীরাই নন, টার্মিনালের ভাসমান বিক্রেতারাও এই সময়ে বেকার হয়ে ছিলেন।
মহাখালী টার্মিনালে ঘুরে ঘুরে ঘড়ি বিক্রি করেন কুষ্টিয়ার সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “যেই কয়দিন লকডাউন ছিল সেই কয়দিন আমি বসা। একটা টাকাও রুজি হয়নি। ঋণ কইরে চললাম কয়টা দিন। আইজকে আবার খুলল, আমি ঘড়ি হাতে বাড়ালাম।”
টার্মিনালে কাপড় বিক্রি করেন মো. রবিন। প্রতি ঈদের আগে টার্মিনাল থেকেই ঘরমুখী মানুষ জামা-কাপড় কেনেন। সে কারণে রবিন কাপড়ও তুলেছিলেন ব্যাপক। তবে কিছু্ই বেচতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘কী যে কষ্ট ভাই। হাতে কুনো টাকা নাই। সব মাল কিনছি, কিন্তু কিছুই বেচতে পারিনি।’
মহাখালী বাস টার্মিনালের অদূরে তেজগাঁও এলাকায় দুপুর ১টার দিকে বিএরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হয়। সেখানে পরপর কয়েকটি বাস থামিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে কিনা তা তল্লাশি করা হয়।
পরে ৬ নম্বর পথের একটি, বলাকা পরিবহনের একটিসহ কয়েকটি বাসকে জরিমানা করা হয়।
ছয় নম্বর বাসটির চালক মো. জলিল বলেন, তার গাড়িতে এক সারিতে পাঁচটি (২+৩টি করে) আসন। তিন সিটে দুই যাত্রী নেওয়ায় তাকে জরিমানা করা হয়েছে।
হাঁকডাক গাবতলীতেও
দুপুরে গাবতলী টার্মিনালে ঢুকতেই শোনা গেল মাইকে সবাইকে মাস্ক পরে থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে। বাসকর্মীদের সরকার নির্ধারিত সংখ্যার অতিরিক্ত যাত্রী না তুলতে বলা হচ্ছে।
টার্মিনালের ভেতরে বাসের টিকেট কাউন্টারগুলো খুলেছে। তবে বেশিরভাগই ফাঁকা, যাত্রীও কম।
টার্মিনালে ঢোকার মুখেই একটি পরিবার বসে ছিল, তাদের বাস তিনটায়, যাবেন ফরিদপুর।
গাবতলী টার্মিনালের ভেতরেও কর্মীরা বাসের ধোয়া-মোছা, মেরামতে ব্যস্ত।
ঢাকা-খুলনা-আড়পাড়া পথের সৌখিন পরিবহন বাসটি কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছিল না। কোম্পানির ফোরম্যানের দায়িত্বে থাকা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘কতদিন গাড়ি চলে না, ব্যাটারি গ্যাছে বইসা।’
এই টার্মিনালের বাস মেরামতের মিস্ত্রীরাও নিজেদের সরঞ্জাম নিয়ে এক বাস থেকে আরেকটিতে ছোটাছুটি করছেন।
ঢাকা-মাগুরা পথের এম এম পরিবহনের বাসটিতে টুকটাক ইলেকট্রিকের কাজ করাচ্ছিলেন চালক মো. নাজমুল।
তিনি বলেন, “লকডাউনের পুরা সময়টাই গাড়ি নিয়া মাগুরায় রাখছিলাম। কয়দিন পরপর স্টার্ট দিছি। এই কারণে গাড়ির কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে নিজেরা শেষ হই গেছি। দেনা করে চলতে হচ্ছে।“
হানিফ, সোহাগ, শ্যামলী, নাবিল পরিবহনের মতো বড় কোম্পানিগুলোর কাউন্টার থেকে জানানো হয়েছে, তাদের এসি ও নন এসি বাসগুলো আগের শিডিউল মতই চলবে। সব পথেই বাড়তি ভাড়া গুণতে হবে।
আরও পড়ুন