কাল হয়েছে জমি

সত্তরের দশকে বিয়ের পর স্বামী মো. জয়নুদ্দিনের সঙ্গে মিরপুরের বুড়িরটেকে আসেন আকলিমা বেগম। জানতেন, শ্বশুর মোহাম্মদ আলীর অনেক সম্পত্তি। কিন্তু মোহাম্মদ আলীর এই সম্পত্তিই পরে অশান্তির কারণ হয়ে ওঠে বংশধরদের জন্য, যার সবশেষ শিকার আকলিমার ছোট ছেলে সাহিনুদ্দিন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2021, 02:37 PM
Updated : 23 May 2021, 07:08 PM

জমির বিবাদে গত ১৬ মে খুন হন সাহিনুদ্দিন। ওই হত্যা মামলায় এরইমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন লক্ষ্মীপুরের সাবেক সাংসদ এম এ আউয়ালসহ কয়েকজন। র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ গেছে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত দুই আসামির। 

আলীনগরের বুড়িরটেক এলাকায় এখনও বেশ গ্রামের আবহ আছে। বড় খোলা জায়গা, সেখানে গরু পালেন স্থানীয়রা, তবে চাষবাস হয় না।

আলী নগরের একদিকে পল্লবীর মিরপুর সিরামিকস, আরেকদিকে মিরপুর ডিওএইচএস। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্মাণাধীন আবাসন প্রকল্প ন্যাশনাল হাউজিং রয়েছে অন্যপাশে।

মিরপুর সিরামিকসের ভেতর দিয়ে আলী নগরে যেতে হয়। রাতের বেলা সিরামিকসের ফটকগুলো বন্ধ হলে একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন এখানকার বাসিন্দারা।

আলীনগর প্রকল্প

সিরামিক কারখানার পেছনে টিলার মতো জায়গায় একটি বটগাছের তলায় টিনের বাড়িতে থাকেন আকলিমা।

নিজের বসতভিটা দেখিয়ে বললেন, এখানে তার শ্বশুরের মালিকানায় ১০ একর জমি রয়েছে, আশির দশকের শেষে সেগুলো সরকারি বিভিন্ন সংস্থা অধিগ্রহণ করে। কিছু জমিতে সরকারি উদ্যোগে আবাসন তৈরি করা হলেও অনেক জমি এখনো খালি পড়ে রয়েছে।

ওই জমিগুলোর মালিকানা ফিরে পেতে অধিগ্রহণ থেকে অবমুক্ত করার জন্য আকলিমার ছেলেরা সাবেক এমপি এম এ আউয়ালের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।

আউয়াল তখন তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব, তার ভক্ত-মুরিদও আছে। তাকে ‘ভালো মানুষই’ ভেবেছিলেন আকলিমা।

তিনি বলেন, “জমি অবমুক্ত করার জন্য তাই আমমোক্তারনামার মাধ্যমে আউয়ালকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আউয়াল তার ডেভলপার কোম্পানি হাভেলি প্রপার্টিজের মাধ্যমে সেই জমিগুলো প্লট আকারে বিক্রির জন্য গড়ে তোলেন ‘আলীনগর হাউজিং’। বেশিরভাগ জমি এর মধ্যে বেচেও ফেলেছেন আউয়াল।”

স্থানীয়রাও বলছেন, জমিগুলোর মালিক ছিলেন আকলিমার শ্বশুর মোহাম্মদ আলী। পরে তা সরকারের গণপূর্ত বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে। সেই জমিগুলো আমমোক্তারনামায় মোহাম্মদ আলীর বংশধরদের কাছ থেকে নিয়ে বেচে দিয়েছেন আউয়াল।

আউয়ালের হাভেলি প্রপার্টিজ কাঠাপ্রতি জমি বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৬০ লাখ টাকায়। কিন্তু জমির আসল মালিকরা কেউ কিছু পাননি বলে আকলিমার ভাষ্য।

টিলার ওপর বটতলায় সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমার বাড়ি

স্থানীয়দের অভিযোগ, এক পর্যায়ে আউয়াল আশপাশের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ‘দখলের’ চেষ্টা শুরু করেন। তাদের জমি বিক্রির জন্য চাপ দেওয়া হত নানাভাবে। জমিতে কেউ স্থাপনা করলে তা ভেঙে দিত আউয়ালের লোকজন। আউয়ালের ওই ‘সন্ত্রাসী বাহিনীর’ নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুমন বেপারী। সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় সুমনও গ্রেপ্তার হয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, সুমনের বিরুদ্ধে মারামারি, ভাঙচুর, মাদকের কারবার, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ছয়টি মামলা রয়েছে।

শনিবার বুড়িরটেকে গিয়ে দেখা যায়, হাভেলি প্রপার্টিজের আলীনগর প্রকল্প সংলগ্ন একটি প্লটে তৈরি ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে প্লটের সীমানাপ্রাচীরও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্লটটির মালিক অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোস্তফা কামাল। গত ৩০ এপ্রিল রোজার মধ্যে মোস্তফা কামালের বাবা মারা যান। তিনি বাবার দাফন নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে ওই রাতেই তার প্লটের টিনশেড ভবন ভেঙে দেওয়া হয়।

মোস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই এক টুকরো জমি নেওয়ার জন্য খুব চাপ দিচ্ছিলেন এম এ আউয়াল। কিন্তু তিনি সেটা বাজার দরে নয়, অনেকটা পানির দরে কিনতে চান। এ নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠকও হয়।

আকলিমা বেগম

“কিন্তু আউয়াল সাহেব জমিতে কোনো স্থাপনা করতে দিচ্ছিলেন না। সেখানে দুটি ঘর করলে ডিসেম্বরে এক দফা ভেঙে দেয় আউয়ালের সন্ত্রাসীরা। পরে আবারও সেখানে ঘর করি। বাবার মৃত্যুর দিন আউয়ালের সন্ত্রাসীরা সেই ঘরের ওপরও চড়াও হয়। তিন দিন ধরে তারা সেখানে ভাঙচুর চালায়।”

এ ঘটনায় আউয়ালের লোকজনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা করেছেন বলে জানান অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা।

মেজর মোস্তফা কামাল বলেন, “আমার জায়গা দেখাশোনার জন্য মাইনুদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে রেখেছিলাম। যার কারণে পরিবারটি আমার পক্ষে ছিল। পরে মাইনুদ্দিনের ভাই সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করে আউয়ালের সন্ত্রাসী বাহিনী।”

সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগম বলেন, “আউয়াল সাবের কোম্পানি এইহানে আসার পরেই শুরু হইল খুনাখুনি। কী যে অশান্তিত পড়লাম! পোলাগো নামে খালি মামলা দেয়। পোলারা পলায়া থাকে। আমি আর পারি না। কোম্পানির লগে না পাইরা ওগো লগে বসলাম। পাকা কথা হইল। কিন্তু হের পরেও আমার পোলাডারে মারল তারা।”

সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এ পর্যন্ত মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং রকি ও মুরাদ নামে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে জানান ডিবির পল্লবী জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার আহসান খান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মূলত জমি নিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে। এর আগেও ওখানে একাধিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই মামলার তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা ওই মামলাগুলোও পর্যালোচনা করছি আমরা।”

মামলা নিয়ে সংসার মাহমুদার

নিহত সাহিনুউদ্দিনের সঙ্গে মাহমুদা আক্তারের বিয়ে হয়েছিল ১৪ বছর আগে।

মাহমুদা বলেন, বিয়ের পর কিছুদিন তারা ভালোই ছিলেন। এরপর এম এ আউয়ালের কোম্পানি এখানে জমি বেচা শুরু করলে অশান্তি শুরু হয়। প্রায়ই সাহিনসহ এলাকার লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা করান আউয়াল। মামলা হলেই সাহিন, ভাসুর মাইনুদ্দিন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে থাকতেন।

হাভেলি প্রপার্টিজের সাইনবোর্ড। তবে জমিটি এই কোম্পানির নয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

“আমার শাশুড়ি আইনজীবী ঠিক করে ছেলেদের ছাড়িয়ে আনতেন। একাধিকবার জেলেও গেছে সাহিনুদ্দিন। এর আগে গত ডিসেম্বরেও হামলা করেছে সুমন বাহিনী। এভাবেই হামলা-মামলার মধ্য দিয়ে সংসার জীবন চলতেছিল।”

তবে পুলিশ জানিয়েছে, সাহিনউদ্দিনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগে আধডজনের বেশি মামলা রয়েছে। তিনিও ‘একটি বাহিনীর সঙ্গে’ যুক্ত ছিলেন।

সাহিনুদ্দিন খুনের নেপথ্যে

গত বছর কিছু জমি বিক্রি করে একটা বাড়ি করার পাশাপাশি ব্যবসা দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন সাহিন। মায়ের অনুমতি পেয়ে তিনি তাদের ১০ কাঠা জমি বিক্রির চেষ্টা করছিলেন।

আকলিমা বেগমের ভাষ্য, এম এ আউয়াল ওই জমি অন্য কারো কাছে ‘বিক্রি করতে দেবেন না’ বলে জানিয়ে দেন। যে জমির বাজার দর ৬০ লাখ টাকা কাঠা, সাহিন ৩০ লাখ করে চাইলেও আউয়াল তাতেও ‘বেঁকে বসেন’।

স্থানীয় বাসিন্দা সাবু শেখ বলেন, “এসব নিয়ে আউয়ালের সঙ্গে ঝামেলা চলছিল। এর মধ্যে মেজর মোস্তফা কামালের জমিতে ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা হলে কয়েকজন সাক্ষী হয়। এ কারণেও সাহিনুদ্দিনের ওপর ক্ষোভ ছিল আউয়ালের লোকজনের।”

বাবার রক্ত দেখা শিশুটি

সাহিনুদ্দিনের স্ত্রী মাহমুদা জানান, গত রোববার সুমন ফোন করে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় তার স্বামীকে। স্থানীয় যুবক মুরাদ মোটরসাইকেল চালিয়ে সাহিনকে সেখানে নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল তাদের ছয় বছরের ছেলে।

“মোটরসাইকেল থেকে নামতে না নামতেই সাহিনুদ্দিনকে কোপানো শুরু করে সুমনের বাহিনী। বাবার রক্ত দেখে ছয় বছরের বাচ্চাটা ভয় পেয়ে দৌড়ে পাশের নানা বাড়িতে চলে যায়। সেখানে খালার ফোন থেকে আমাকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আব্বুরে কুপাইতেছে সুমনে। আব্বুরে মাইরা ফালাইতেছে’।”

অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোস্তফা কামালের প্লটে গুঁড়িয়ে দেওয়া স্থাপনা

ছেলের ফোন পেয়ে মাহমুদা কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে গিয়ে আর স্বামীকে জীবিত পাননি।

তিনি বলেন, “এরপর থেকে ছেলে ভালো নেই। ভয় পায়, খুব জেদ করে। মাঝেমধ্যে জেদ করে বলতে থাকে, ‘আমি সুমনরে মারুম, আমার আব্বুরে সুমন মারছে’।”

বানেছার নিখোঁজ হওয়া

ভূস্বামী মোহাম্মদ আলীর দশ ছেলে, দুই মেয়ে। তাদের মধ্যে দুই ছেলের পরিবার কেবল পল্লবীর আলী নগরে বসবাস করেন। কারও অবস্থাই তেমন ভালো না। মোহাম্মদ আলীর এক মেয়ে বানেছা বেগম গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে নিখোঁজ।

বানেছার কিশোর ছেলে মো. রাব্বী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, তার মায়ের নামেও এখানে জমি ছিল। এসবের লোভে নিকট আত্মীয়দেরই কেউ তার মাকে গুম করেছে বলে তাদের সন্দেহ।

রাব্বীর দাবি, মামাতো ভাইয়েরা এর আগে তার ‘পকেটে মাদক দিয়ে’ পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

বানেছার প্রতিবেশী সাবু শেখ বলেন, “বানেছা অনেকটা মানসিক রোগীর মতো আচরণ করতেন। এলাকায় প্রচার, বানেছার টিপসই দেওয়া কাগজ বলে নকল কাগজ তৈরি করেছেন এম এ আউয়ালের লোকেরা।”

আরও যত খুনোখুনি

স্থানীয়দের ভাষ্য, জমিজমাকে কেন্দ্র করে গত ছয় বছরে ওই এলাকায় আরও অন্তত দুটো খুন হয়েছে।

২০১৫ সালের ১৪ মে বুড়িরটেকে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় বঙ্গবন্ধু কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র চঞ্চলকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

ওই হত্যা মামলার আসামি ছিলেন স্থানীয় মমিন বক্স। কিছুদিন পর মমিন খুন হলে চঞ্চলের পরিবারের সদস্যদের ওই হত্যা মামলায় আসামি করা হয়।

চঞ্চল হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছিল এম এ আউয়ালের ব্যবস্থাপক আবু তাহেরকেও। সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলাতেও তাহেরকে আসামি করা হয়েছে।