অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট: কী আছে এ আইনে

সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর আলোচনায় এসেছে শতবর্ষ পুরনো আইন অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেদী হাসান পিয়াসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2021, 06:01 PM
Updated : 18 May 2021, 06:45 PM

প্রথম আলোর এই জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে মামলা করেছে, তাতে ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের দুটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে।

রোজিনার বিরুদ্ধ অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি এক কর্মকর্তার কক্ষ থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়’ সরকারি নথি চুরির চেষ্টা করেন এবং মোবাইলেও ছবি তোলেন।

যদিও রোজিনা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন; সহকর্মীরা দাবি করছেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নিয়ে আলোচিত কিছু প্রতিবেদনের জন্য তিনি আক্রোশের শিকার হয়েছেন।

রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। এই দুটি ধারার সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।

১৯২৩ সালের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের’ ৩ ও ৫ ধারায় গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখার অভিযোগও আনা হয়েছে। ৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। আর ৫ ধারা অনুযায়ী সাজা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে অথবা ১৪ বছরের কারাদণ্ড। তবে সর্বনিম্ন সাজা ৩ বছরও হতে পারে।

তবে উপনেশিক আমলে প্রণীত এই আইনের স্বাধীন দেশে রাখার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজ্ঞরা। এই আইনটি আবার তথ্য প্রকাশ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মত রয়েছে।

এই আইন কবে থেকে

ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে ১৯২৩ সালের ২ এপ্রিল ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। লর্ড কার্জন যখন ভাইসরয় ছিলেন, তখনই আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

পাকিস্তান আমল পেরিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৩০ জুন প্রণীত ‘দ্য বাংলাদেশ ল’জ (রিভিশন অ্যান্ড ডিক্লারেশন) অ্যাক্ট –এর ‍দ্বিতীয় তফসিলে দুটি শব্দ পরিবর্তন করে সরকারি গোপনীয়তা সংক্রান্ত ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ আইনটি আত্মীকরণ করে বাংলাদেশ।

আইনটির সংজ্ঞায় সরকারি জায়গা, যোগাযোগের মাধ্যম, নিষিদ্ধ এলাকা ইত্যাদি কতগুলো বিষয় সংজ্ঞায়িত করে বিধি-নিষেধ-শাস্তি আরোপ করা হয়েছে।

আইনে ‘সরকারি জায়গা’ বলতে সরকারের যে কোনো বিভাগ কর্তৃক দখলকৃত জায়গাকে বোঝানো হয়েছে, যা ওই বিভাগের ন্যস্ত করা হোক বা না হোক। 

‘যোগাযোগ বা যোগাযোগের মাধ্যম’ বলতে কোনো স্ক্যাচ, প্ল্যান, মডেল, ডকুমেন্ট, আর্টিকেল, তথ্য বা এসবের আংশিক বা সম্পূর্ণ বর্ণনা বা ফলাফল দ্বারা যোগাযোগ করাকে বোঝানো হয়েছে।

আর ‘নিষিদ্ধ এলাকা’ বলতে সরকার গেজেট জারি করে যে জায়গা বা এলাকাকে নিষিদ্ধ করেছে, সে জায়গা বা এলাকাকে বোঝানো হয়েছে।  

কী অপরাধে কী শাস্তি

আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে।

৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নকশা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না।

৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বিদেশি এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবর সংগ্রহ করা যাবে না।

আবার এ আইনের ৩(১)ধারায় গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অথবা স্বার্থের পরিপন্থি কোনো উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ এলাকায় গমন করে, শত্রু পক্ষের উপকারে আসার মতো কোনো স্কেচ. প্ল্যান, মডেল অথবা নোট তৈরি করে কিংবা কোনো অফিসিয়াল গোপন কোড অথবা পাসওয়ার্ড অথবা নোট অথবা অন্য কোনো দলিলপত্র অথবা তথ্য আহরণ করে, রেকর্ড করে, প্রকাশ করে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে পাচার করে, তবে সে এই ধারার অপরাধে অপরাধী হবে।

৩(২) ধারায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের পরিপন্থিমূলক কাজ এবং ৩(৩)(ক)ধারায় অপরাধটি বিদেশি শক্তির স্বার্থে বা প্রয়োজনে করা হয়েছে বলে ধারণা করা গেলে বা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে তিন অনধিক তিন বছর কারাদণ্ড।

আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নিষিদ্ধ এলাকা ও সরকার ঘোষিত কোনো এলাকা সম্পর্কীয় কোনো গোপনীয় অফিসিয়াল কোড বা পাসওয়ার্ড বা কোনো স্কেচ, প্ল্যান, মডেল, আর্টিকেল, নোট, দলিলপত্র অথবা তথ্য কোনো ব্যক্তি আইনসঙ্গত দখলে বা নিয়ন্ত্রণে রেখেও যদি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করে, যদি অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন তথ্যাদি অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্র ব্যবহার করে, তাতে সেই ব্যক্তি অপরাধী হবে।

৫ (ক) উপধারা অনুযায়ী কোনো প্রতিরক্ষা নির্মাণকাজ, অস্ত্রাগার, নৌ, স্থল বা বিমান বাহিনীর স্থাপনা বা স্টেশন বা খনি, মাইনক্ষেত্র, কারখানা, ডকইয়ার্ড, ক্যাম্প বা বিমান বা গোপনীয় অফিসিয়াল কোড সংক্রান্ত অপরাধে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা ১৪ বছর কারাদণ্ড। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছর কারাদণ্ড।

রোজিনা ইসলামের সহকর্মীরা মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি তাকে সচিবালয়ে আটকে রাখায় জড়িতদের শাস্তিও চেয়েছে।

 

বিতর্ক কোথায়

একজন সাংবাদিককে এই আইনে আসামি করে মামলা দেওয়ার পর দেশের স্বাধীন বা মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেক সংগঠন। বর্তমান আমলে আইনটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্য ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’র মতো অনেক আইন করেছে। কারণ তাদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয় ছিল। তখন সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের প্রচলন বা বিকাশও খুব একটা ছিল না।

“কিন্তু আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে যে বিষয়গুলোকে নিশ্চিত করা হয়েছে, তার মধ্যে মত প্রকাশের বা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও কিছু কিছু আইন রয়ে গেছে। তবে এগুলোর খুব একটা ব্যবহার নাই। এখন হাঠাৎ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আইনটির ব্যবহার আমি বলব আইনের অপপ্রয়োগ। আইনগতভাবে এ আইনটি প্রয়োগের সুযোগও নাই।”

মানবাধিকার প্রশ্নে বহু মামলা পরিচালনাকারী এই আইনজীবী বলেন, “গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সাথে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি জড়িত। বিশেষ করে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তথ্য বের করা এখন রাষ্ট্রের জন্য, জনগণের জন্য খুবই প্রয়োজন।

“এ অবস্থায় এসব আইন দিয়ে সাংবাদিক, সংবাদ মাধ্যমকে কোনঠাসা করার যে চেষ্টা, তা আমাদের সংবিধানের সাথে যায় না। আর মামলা যারা করেছে তারা না বুঝেই করেছে।”

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন, “সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। প্রকারান্তরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদকে জীবীত রাখে। এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কেউ যদি ব্রিটিশ আমলের এসব আইন দ্বারা নিগ্রহের শিকার হন, তবে সেটা সংবিধানের লঙ্ঘন।”

জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন-২০১১ এর উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, “এ আইনের সঙ্গে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ সরাসরি সাংঘর্ষিক। কারণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ আইনের ৪, ৫ ও ১৪ ধারায় তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। এমনকি তথ্য প্রকাশকারীকে পুরস্কৃত করার কথাও বলা হয়েছে।”

“এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম সাংঘর্ষিক বিদ্যমান দুটি আইনের মাঝে কোনটা প্রাধান্য পাবে। সে হিসাবে আমি বলব, সাংঘর্ষিক দুটি আইনের মধ্যে যে আইনটি নতুন অর্থাৎ সর্বশেষ নতুন আইনটিই প্রাধান্য পাবে,” বলেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যেতির্ময় বড়ুয়া এক ফেইসবুক পোস্টে এ আইনের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরে বলেছেন, “২০১১তে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন পাস হয়েছে, কিন্তু এর ব্যবহার নেই। সাংবাদিকরাও এই আইনের সুযোগ নেননি।”

‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’র সাথে এ আইনের সাংঘর্ষিক দিক তুলে ধরে তিনি তার পোস্টে লিখেছেন, “দুটো আইন কিভাবে সাংঘর্ষিক হয়েও এখনও ব্যবহার হচ্ছে, সেটি দেখার বিষয়। রোজিনা ইসলাম যদি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য নিয়েও থাকেন, তা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়ার কথা এবং রোজিনাকে পুরস্কার দেওয়ার কথা ছিল।”