বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ব্যবহৃত এই সুরক্ষা সামগ্রীই আবার অন্যের বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির ঝুঁকি তো আছেই।
যত্রতত্র ফেলে দেওয়া এসব মাস্কের সঙ্গে কোথাও কোথাও মিলছে গ্লাভসও। বাসাবাড়ির গৃহস্থালীর যে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে- সেখানেও থাকছে এ ধরনের বিপুল সামগ্রী, যেগুলোকে বলা হচ্ছে ‘কোভিড বর্জ্য’।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সার্বিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সীমাবদ্ধতা আছে বলেই ‘কোভিড বর্জ্য’ নিয়ে শঙ্কা জাগছে।
“বাসা-বাড়িতে কোভিডের সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারের পর আলাদাভাবে সেটা রাখা এবং আলাদা করে সংগ্রহ করার কথা। আমাদের সিটি করপোরেশন সেটা করছে কিনা জানা নেই। যদি না করে থাকে তবে যারা এই বর্জ্য সংগ্রহ করছেন, তারা সংক্রমিত হবেন। আবার তাদের থেকে অন্যরা।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালগুলোর বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা করা গেলেও বাসাবাড়ির ‘কোভিড বর্জ্য’নিয়ে এখন পর্যন্ত আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
তাতে একদিকে মহামারীকালে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি ড্রেন-নালায় জমে থেকে জলাবদ্ধতা তৈরির ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।
এজন্য নাগরিকদের ‘অসচেতনতাকে’ দায়ী করছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। তাদের বক্তব্য, মানুষ সাধারণ গৃহস্থালীর আবর্জনার সঙ্গে ‘কোভিড বর্জ্য’ মিশিয়ে ফেলায় আলাদা করে এর ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না।
সচরাচর রাজধানীর বর্জ্য যেভাবে আমিনবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় ‘ডাম্প’ করা হয়, এক্ষেত্রেও হচ্ছে তাই।
‘কোভিড বর্জ্য’ আলাদা করা সম্ভব না হওয়ায় এবং সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পোড়ানোর ব্যবস্থা না থাকায় সব বর্জ্য একসঙ্গেই এসব ‘ডাম্পিং এলাকার’ খোলা জায়গায় ফেলা হচ্ছে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন বলছেন, সঠিক তথ্য না থাকার কারণে কোভিড বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না।
“দৈনন্দিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কোভিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি পার্থক্য রয়েছে। আমার কাছে যদি তথ্য থাকে যে, কোনো একটি এলাকায় কী পরিমাণ কোভিড রোগী আছে। কোন কোন বাসায় আছে, তাহলে আমি সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতে পারব। আমার কাছে তো কোনো তথ্যই নেই। তাহলে আমি কী করে কাজ করব?
“তাছাড়া মানুষ এখানে সচেতন নয়। আলাদা করে দেওয়া তো দূরের কথা, যত্রতত্র মাস্ক, গ্লাভস ফেলছেন। আমরা সবসময় নাগরিকদের সচেতন করছি। কিন্তু উল্টো দিকের রেসপন্সটাও আমাদের পেতে হবে।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এসএম শফিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোভিড বর্জ্য নিয়ে গত বছর মহামারীর বিস্তারের শুরু থেকে সচেতনামূলক কাজ করেছি। প্রতীকী হিসেবে মানুষকে মাস্কসহ অন্য ব্যবহৃত কোভিড বর্জ্যের জন্য আলাদা ব্যাগ সরবরাহ করেছিলাম। বলেছিলাম, এ জাতীয় বর্জ্য যেন আলাদা করে দেওয়া হয়। প্রথম দিকে কিছু মানলেও এখন নিত্য বর্জ্যের সঙ্গে কোভিড বর্জ্য মিশিয়ে ফেলছে।”
প্রিজম বাংলাদেশ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাসাবাড়ির কোভিড বর্জ্যের ব্যবস্থাপনায় কিছু কাজ করছে।
এর নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার আনিসুর রহমান জানালেন, গতবছর দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠকে গৃহস্থালী থেকে আলাদা করে কোভিড বর্জ্য সংগ্রহ করা হলে তা ধ্বংসের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তারা।
“দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সেটা পারেনি। উত্তরের পাঁচটি জোন কোভিড বর্জ্য রাখে। আমরা সংগ্রহ করি। কিন্তু যে পরিমাণ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী আসার কথা, তা আসছে না। দুই এলাকাতেই সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে কোভিড বর্জ্য মিশে যাচ্ছে।“
মোহাম্মপুরের মোহাম্মাদীয়া হাইজিং এলাকায় বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ফোরকান মিয়া জানান, গতবছর মহামারীর শুরুর দিকে বিভিন্ন বাসা থেকে মাস্কসহ অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী আলাদা প্যাকেটে দেওয়া হত। এখন তা আর হচ্ছে না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন অন্য ময়লার সাথে মাস্ক, গ্লাভস সবই থাকে। আমরা ডিপোতে নিয়ে সব একসাথেই সিটি করপোরেশনের গাড়িতে তুলে দিই”।
ওই জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সুরক্ষা সামগ্রীর বর্জ্য ও মেডিকেল বর্জ্যের মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে।
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনও (এসডো) এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল গত বছর মে মাসে।
এক বছর পরের অবস্থা জানতে চাইলে এসডোর মহাসচিব শাহরিয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত এক বছরের প্লাস্টিক বর্জ্য, বিশেষ করে যেটাকে আমরা ‘কোভিড বর্জ্য’ বলছি, সেটা বেড়েছে।”
কতটা বেড়েছে- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা গত বছর যে গবেষণা করেছিলাম, তার পরের ধাপের গবেষণার ফল খুব শিগগির প্রকাশ করব। যে প্রবণতা দেখেছি, তাতে দ্বিগুণ বলা যাবে না, তবে আগের চেয়ে বেড়েছে।”
এসডোর সমীক্ষা বলছে, একবার ব্যবহৃত হয়- এমন দ্রব্য থেকে গতবছর এপ্রিলে এক মাসে দেশে ১৪ হাজার ১৬৫ টন ক্ষতিকর প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। এর ১২ দশমিক ৭ শতাংশ এসেছে সার্জিক্যাল ফেইস মাস্ক থেকে।
ওই সময়ে প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি সার্জিক্যাল ফেইস মাস্ক ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে অন্তত ১ হাজার ৫৯২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। অন্য শহরের তুলনায় ঢাকায় এর পরিমাণ বেশি।
রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা প্রিজম বাংলাদেশের এক হিসাব বলছে, মহামারীর আগে যেখানে ১৪ টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হত, বর্তমানে সেটা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে বর্তমান বর্জ্যের ৭০ ভাগই ‘কোভিড বর্জ্য’।
আনিসুর রহমান বলেন, “এখন ঢাকায় মেডিকেল বর্জ্য কমে গেছে। জরুরি অপারেশন ছাড়া এখন অন্য রোগী হাসপাতালে যাচ্ছে কম। সে কারণে এই বর্জ্য কমেছে। কোভিড রোগীই হাসপাতালে বেশি যাচ্ছে।”
ঢাকার সব হাসপাতাল থেকে প্রিজম বাংলাদেশ বর্জ্য সংগ্রহ করে বলে দাবি করেন এর নির্বাহী পরিচালক আনিসুর।
তিনি বলেন, “বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা বর্জ্য সংগ্রহ করি না। কিন্তু বাড়িতেও মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস মানুষ ব্যবহার করে। সেগুলোও কোভিড বর্জ্য। এগুলো সংগ্রহ করতে পারছি না।“
মেডিকেল বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা হচ্ছে কিনা- এই প্রশ্নে আনিসুর বলেন, “ওয়েল ম্যানেজড আমি বলব না। শুরু থেকে আমরা বায়োসেইফটি ব্যাগ ব্যবহারের কথা বলছি, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। কিছু বেসরকারি হাসপাতাল সেটা পেরেছে, সরকারি হাসপাতাল পারেনি। তারা ড্রামে রাখছে। এটা সঠিকভাবে করা দরকার। এটা আমাদের দৈন্য।”
পরে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (বর্জ্য ব্যবস্থাপনা) আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবেশ অধিদপ্তর সরাসরি মাঠে থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে না। আমরা নির্দেশনামূলক কাজ করি, পরামর্শ দিই। কোথাও নিয়ম লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা সেটা দেখি।
“গতবছর মহামারীর বিস্তারের পর থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে যারা কাজ করে তাদেরকে কোভিড বর্জ্য নিয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনামূলক কাজ চলমান রয়েছে।।”
চিকিৎসা-বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা সংশোধন নিয়েও অধিদপ্তর কাজ করছে বলে জানান এই সরকারি কর্মকর্তা।