মহামারীর ঈদযাত্রা: যে যেভাবে পারে, বাইকে কিংবা ট্রাকে

ভাইরাস ভয় দেখাচ্ছে, আর মহামারী ঠেকাতে সরকার দিয়েছে বিধিনিষেধ; তাতে কি?

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2021, 04:12 AM
Updated : 12 May 2021, 04:50 AM

সামনে বাবা, পেছনে মা, মাঝে ঘুমন্ত শিশুকে নিয়ে ঢাকা ছাড়ছে মোটর সাইকেল। অথবা ট্রাকের পেছনে ত্রিপলের ছাউনির নিচে পুরো পরিবার।

সবার গন্তব্য গ্রামের বাড়ি। আর একদিন বাদেই তো ঈদ! 

নিষেধ না মানা এই ঈদযাত্রায় গত কয়েক দিন ধরেই শিমুলিয়া ফেরিঘাটের পথে মানুষের ঢল দেখেছে বাংলাদেশ। ফেরিতে গাদাগাদি করে চড়ে পদ্মা পার হয়ে দক্ষিণের জেলাগুলোতে ছুটেছে মানুষ।

বুধবার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা গেলে বৃহস্পতিবার ঈদ হতে পারে বাংলাদেশে, না হলে শুক্রবার। তাই বুধবার ভোর থেকেই ঢাকার গাবতলীতে দেখা গেল মানুষের স্রোত। তাদের গন্তব্য উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা। মূল বাহন ট্রাক ও মোটরসাইকেল। 

ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও রওনা হয়েছেন কেউ কেউ। সেই ভিড়ের মধ্যে সরকারি দপ্তরের এসইউভি, পুলিশের স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেলও দেখা গেল।

ভোর পৌনে ৫টার দিকে গাবতলীর মোহনা পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে ৩০ সেকেন্ডে ৩৫টি মোটরসাইকেল গোনা গেল। দুই চাকার এসব বাহনে দুজন, তিনজন আরোহী, সঙ্গে ব্যাগ-বোঁচকা।

গাবতলীর এসপি ফিলিং স্টেশনে ভোর ৫টার দিকে তেল নিতে মোটরসাইকেলের ভিড় জমে যায়। এক মোটরসাইকেলে দেখা গেল পোষা কবুতরও ঈদযাত্রায় সঙ্গী হয়েছে। হইচই চিৎকারে ভয়ার্ত পাখিগুলোও বাইকের পাশে ঝুলে যাচ্ছে দূরের কোনো জেলায়।

এসপি ফিলিং স্টেশনে তেল নেওয়ার পর তিন বন্ধু যাত্রা পথ নিয়ে পরামর্শ করছিলেন। তিনটি দেড়শ সিসির মোটরসাইকেলে তারা চলেছেন জয়পুরহাটের পথে।

তাদের একজন জিসান আহমেদ বললেন, “বাইক নিয়ে এর আগে শখ করে লং ট্যুরে গিয়েছি। এবারই প্রথম বাড়ি যাচ্ছি। বাবা-মাকে ছেড়ে ঢাকায় ঈদ করতে মোটেও ভালো লাগবে না।”

মিরপুর থেকে আসা পাঁচজনের একটি পরিবার দাঁড়িয়ে ছিল এসপি পাম্পের এক কোনায়। তাদের চারজনই নারী, সবাই পোশাক কারখানায় কাজ করেন। যাবেন বগুড়ায়, তবে আগাম কোনো বন্দোবস্ত করেননি। যে বাহন পাবেন, সেটাতে উঠবেন বলে মনস্থির করে এসেছেন। সঙ্গে থাকা আফজাল হোসেন বললেন, “যাইতে তো চাইছিলাম, কিন্তু গাড়ি ঘোড়া কিছু পাচ্ছি না। কষ্ট করবার পারমো, কিন্তু গাড়িই তো দেখিচ্চি না।” 

কিছুক্ষণ পর পরিবারটিকে দেখা গেল ট্রাকে ওঠার জন্য ভাড়ার দরদাম করছে। ট্রাকচালকের সহকারী জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বললেন, “এক দাম এক হাজার, তিরপল লাগাইছি বৃষ্টি হইলেও সমস্যা নাই।”

দেখা গেল ট্রাকের (বগুড়া ট ১১ ১৮৭০) পেছনে ছাউনির মত করে ত্রিপলের আচ্ছাদন। সেই পরিবারটি দরদাম করতে করতে আমিন বাজার ব্রিজের উপরে এসে ট্রাকে উঠল। ভাড়া জনপ্রতি ৬০০ টাকা। 

সেখানে দেখা গেল যাত্রী তোলার জন্য দামদর করতে করতে খুব ধীরে এগোচ্ছে অনেকগুলো ট্রাক। তাতে ভোরের রাস্তায় আমিনবাজার থেকে টেকনিক্যাল মোড় পর্যন্ত যানজট লেগে গেছে।

গাবতলী ফাঁড়ির সামনে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা গেল। তবে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে তাদের কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না।

সকাল ৬টার দিকে আমিন বাজার ব্রিজের গোড়ায় এসে দাঁড়ালেন মুজাহিদ নামে একজন পুলিশ সার্জেন্ট। তাতেই যেন কিছুটা গতি পেল ট্রাকগুলো। 'ওস্তাদ চালু চালু, পিছে সার্জেন্ট'- বলে চালকদের তাড়া দিলেন সহকারীরা।

ট্রাকের ভিড় এরপর সরে গেল আমিনবাজার সেতুর দিকে। সেতুর উপর দেখা গেল টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া বলে ডেকে চলেছেন কয়েকজন।

তারা গাবতলীর পরিবহনকর্মী। ট্রাকের জন্য যাত্রী ডেকে দিচ্ছেন, যাত্রী উঠলে কমিশন পাবেন।

তারা ভাড়া চাইছিলেন টাঙ্গাইল ৫০০, সিরাজগঞ্জ ৬০০, কুষ্টিয়া ১ হাজার টাকা। বেশ কয়েকজন ভাড়া নিয়ে দামদরও করছিলেন। তাদের ভিড়ে ফুটপাতেও জট।

পাশ থেকে ট্রাক চালক আনোয়ার হোসেন বললেন, “ওঠেন, খালি গাড়ি আছে, টাইনা জামুগা। ট্রাকে না গেলে ভাইঙ্গা যাইতে হইব।”

যাত্রী ওঠানোর জন্য ট্রাকগুলো খুব ধীরে চললেও প্রাইভেটকার আর মোটরসাইকেলগুলো সামনে এগিয়ে যেতে ব্যস্ত। ক্রমাগত হর্ন বাজিয়ে চলেছেন ছোট এই যানগুলোর চালকরা। কান ঝালাপালা অবস্থা।

এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেলে বাবা-মায়ের মাঝে থাকা শিশুটি কাঁচা ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল। কথা হল তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। তবে তাড়ার মধ্যে তাদের নাম জানা হল না।

শিশুটির মা বললেন, “ভোরবেলা ঠাণ্ডা লাগে, সেইজন্য বাচ্চাকে গরম কাপড় পরায়ে আনছিলাম। এখন গরম লেগে গেছে, এজন্য কাঁদছে।”

আমিনবাজার সেতু পার হতেই বাসকর্মীদের হাঁকডাক। ‘ঘাট ৩০০ টাকা’ বলে ডাকছেন কেউ কেউ। কয়েকজন আবার 'নবীনগর-চন্দ্রা বাইপাইল' বলে চিৎকার করে চলেছেন।

বাস কর্মীরাই মানুষকে বলে দিচ্ছেন, চন্দ্রা গেলে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়ার গাড়ি মিলবে। যাত্রীরা উঠছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রী নিয়ে রওনা দিচ্ছে বাসগুলো।

এই ভিড়ভাট্টার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির বালাই কোথাও নেই। বাসগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া হচ্ছে দাঁড়িয়ে। একেবারে ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি অবস্থা। 

মিরপুরের কালশী থেকে এসেছেন সাতজনের একটি দল। এক ঠিকাদারের অধীনে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তারা, যাবেন নীলফামারী।

তাদের একজন সোহেল রানা বললেন, “হামার কি সবাই চ্যাংড়া মানুষ, যেইটা পামো সেটাতেই যামো।”

তবে ট্রাকগুলো অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ায় কোনো বাহনেই উঠতে পারছিলেন না এই মানুষগুলো। শেষে ঢাকায় গরু নিয়ে এসে ফিরতি পথের একটি খালি ট্রাকে তাদের উঠতে দেখা গেল। 

আমিনবাজার পার হওয়ার পর রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। প্রাইভেট কারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা গেল একটানে।

সেখানে কিছুটা যানজট। পাশের রাস্তা দিয়ে আশুলিয়া এলাকা থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা যানবাহনগুলো মহাসড়কে উঠছে। যানজট সে কারণে।

এরপর কিছুটা পথ পেরিয়ে নবীনগরে এসে আবার জটে পড়তে হল। আশপাশের এলাকার পোশাককর্মীরাও ঈদে বাড়ি যাবেন। তাদের তুলতে রাস্তার পাশে পাশে থেমেছে অনেক ট্রাক। ফলে চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

ট্রাকে লোকজন ওঠার সময় ছবি তুলতে গেলে লোকমান হোসেন নামে একজন বললেন, “দেখেন সরকার হামাক কি বিপদে ফেলছে। বাসের দুইগুণ ভাড়া দিয়ে ট্রাকে যেতে হইচ্ছে।”