কেউ যদি জানতে চান ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক খোলা কী না, তবে উত্তর হচ্ছে ‘না’। তাহলে কী রাস্তা বন্ধ?
এক্ষেত্রেও উত্তর হচ্ছে ‘না’। রাস্তা খোলাই আছে।
তবে মহামারীকালের ‘কঠোর’ এই বিধিনিষেধের ঈদযাত্রায় মানুষের পথচলায় থাকছে একরাশ অনিশ্চয়তা, কেননা এর অনেকটাই নির্ভর করছে কর্মকর্তাদের ‘মর্জির’ ওপর।
পড়িমরি করে গ্রামের পথে ছুটে চলা মানুষজন মঙ্গলবার সড়কের কড়াকড়ির ‘শিকার’হয়ে ঘাটে এসে স্বস্তি পাচ্ছেন। দেখছেন ফেরি চলছে একদম স্বাভাবিকভাবেই।
তবে বিকালের পর থেকে পদ্মার ওপারে বাড়িতে যেতে যাত্রীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ফেরিতেও গাদাগাদি অবস্থা তৈরি হয়।
মঙ্গলবার দিনভর সড়কের কড়াকড়ি মেনে যারা ঘাট পর্যন্ত আসতে পেরেছেন তারা গাড়ি ও মোটরসাইকেলসহ ফেরিতে উঠতে পেরেছেন।
আবার অনেককেই ফিরে যেতে হয়েছে মাঝপথ থেকেই। আর যাদের নিজস্ব বাহন নেই তারা অন্তত চারবার যানবাহন বদলে, দীর্ঘ পথ হেঁটে গিয়ে ফেরিতে উঠেছেন।
চরম ভোগান্তির সঙ্গে রয়েছে বাড়তি খরচ। এটুকু পথ যেতেই খরচ হচ্ছে হাজার টাকার বেশি।
শিমুলিয়া ঘাটে কথা হয় পটুয়াখালীগামী জাফর ইকবালের সঙ্গে। স্ত্রী আর ১০ মাসের মেয়েকে নিয়ে তিনি ঈদযাত্রায় পটুয়াখালীর পথ ধরেছেন।
ঢাকার বাবুবাজার থেকে অটোরিকশায় প্রথমে আব্দুল্লাহপুর টোলপ্লাজা পর্যন্ত এসেছেন। টোলপ্লাজা পেরিয়ে হেঁটে প্রায় এক কিলোমিটার এসে তিনি একটি পিকআপে খানবাড়ি গোলচত্বর পর্যন্ত আসতে পারেন। সেখানে আবার তাদের নামিয়ে দেয় পুলিশ।
এরপর তিনি গোলচত্বরে কিছুটা হেঁটে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় শিমুলিয়া মোড় পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। সেখানে নেমে সামান্য হাঁটতেই পেয়ে যান আরেকটি অটোরিকশা। এবার ২০ টাকা ভাড়ায় শিমুলিয়া থেকে ঘাটের মুখে হলদিয়া এলাকা পর্যন্ত যেতে পারেন।
সেখান থেকে তিন নম্বর ঘাট পর্যন্ত যেতে আবার প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেঁটেই পাড়ি দিতে হয় পরিবারটিকে। মোট সময় লেগেছে চার ঘণ্টা। খরচ হয়েছে প্রায় দুই হাজার একশ টাকার মতো। কখনো রোদ-গরম আবার কখনো বৃষ্টিতে কষ্ট পেয়েছে কোলের শিশুটি।
মঙ্গলবার সকালে ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে শিমুলিয়া ঘাটের পথে রওনা দিয়ে প্রথম চেকপোস্টটি পাওয়া গেল আব্দুল্লাহপুর টোলপ্লাজায়। সেখানে কর্তব্যরত বিজিবি সদস্যরা সর ব্যক্তিগত গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন।
সিরাজদিখানের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দ ফয়েজুল ইসলাম ঘুরে ঘুরে কর্তব্যরত পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের বলছেন, ‘কোনো প্রাইভেট কার টোলপ্লাজা পার হবে না।’
টোলপ্লাজায় আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে দেখা গেল, প্রাইভেট কারের কয়েকজন যাত্রী ঘুরছেন ইউএনও’র পিছু পিছু। তারা প্রত্যেকেই বলছেন তাদের যাওয়া জরুরি।
কেউ কারণ হিসেবে বলছেন, তাদের নিকটাত্মীয় স্ট্রোক করেছেন, কেউ বলছেন চিকিৎসার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন এখন বাড়িতে ফিরছেন, কেউ পাসপোর্ট দেখিয়ে বলছেন তিনি বিদেশ থেকে ফিরলেন।
এদের কেউ কেউ টোলপ্লাজা পার হতে পারছেন, আবার কাউকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ডিএম পরিবহন নামের একটি বাসের চালক আবুল কালামও ঘুরছেন ইউএনওর পিছু পিছু। সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে বাস চালানোয় আবুল কালামের গাড়ির চাবি আটকের আদেশ দিয়েছেন ইউএনও।
আবুল কালাম বললেন, তিনি একটি কারখানার কর্মী বহন করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। তখন ইউএনও মনে করিয়ে দিলেন ওই কারখানাটিই নাকি বন্ধ।
বেলা ১১টার দিকে খানবাড়ি গোলচত্বরে গিয়ে দেখা গেল মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গাড়িতে বসে রয়েছেন। আর রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে লৌহজং থানার পুলিশ। তখন মোটরসাইকেলগুলোকে মোটামুটি বিনা বাধায় ঘাটের দিকে যেতে দেওয়া হচ্ছিল। তবে ব্যক্তিগত গাড়িগুলোকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। অনেককে ছেড়েও দেওয়া হচ্ছিল।
পুলিশের সবাই অনেক নমনীয়। তবে বেলা দেড়টার দিকে একই এলাকায় গিয়ে দেখা গেল পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল কোনটিই ঘাটের দিতে যেতে দিচ্ছে না পুলিশ। এমনকি কোনো গাড়ির যাত্রী সেখানে দাঁড়িয়ে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেই সজোরে ধমক দিচ্ছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।
পরিজন নিয়ে ঘাটমুখী মোটরসাইকেলগুলোকেও ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো চালক দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করা মাত্রই লাঠি হাতে তেড়ে আাসছেন পুলিশের সদস্যরা। পরিস্থিতির এই পরিবর্তন বোঝার জন্য সেখানে থামতে হল।
পুলিশের এক সদস্য এসে মোটরসাইকেলে ঝুলিয়ে রাখা হেলমেটে লাঠি দিয়ে এমন আঘাত করলেন যে, হেলমেটটিই ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেল। সেখানে দায়িত্বরত মুন্সিগঞ্জ সদরের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আসাদুজ্জামান জানালেন, ‘ডিআইজি স্যার আসছেন।’
বেলা পৌনে ২টার দিকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির গাড়িবহর ঝড়োগতিতে ওই এলাকা অতিক্রম করল। যেজন্য এতক্ষণ ধরে এত আয়োজন তিনি অবশ্য সেখানে এক সেকেণ্ডও দাঁড়ালেন না।
সড়কে কড়াকড়ি হলেও ফেরিঘাটে ফেরি চলছে স্বাভাবিক। সবগুলো ঘাটের মুখেই ফেরির টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ৫-৬ জন কর কর্মী। জনপ্রতি ২৫ টাকা করে টিকিট কিনতে হচ্ছে। সবগুলো ঘাটেই কিছুক্ষণ পরপর এসে ফেরি ভিড়ছে।
তবুও মানুষ হুড়োহুড়ি করেই ফেরিতে উঠছেন। ঘাটে গিয়ে যানবাহনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ফেরি দেখে হিমেল নামে একজন চালক বললেন, ‘ঘাটে ফেরি বইয়া রইছে, আর আমাগো রাস্তা দিয়া আইতে দেয় না।’
বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাট এলাকার ব্যবস্থাপক (মেরিন) আলী আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৬টি ফেরির মধ্যে ১৫টিই চলছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যাত্রীর বেশ চাপ ছিল। এরপর সন্ধ্যার দিকে স্রোতের মতো মানুষ আসতে থাকে। ইফতারির পর যাত্রীর চাপ ছিল সবচেয়ে বেশি।“
তিনি জানান, একেকটি ফেরির ঘাট ছেড়ে গিয়ে ঘুরে আসতে গড়ে আড়াই ঘণ্টার মতো লাগছে। বেশি বাতাস হলে ডাম্প ফেরিগুলো একটু বাড়তি সময় নিচ্ছে।
আরও পড়ুন