তাদের জন্য ঈদও এখন ‘বিলাসিতা’

এমনিতে ফেরি করে গৃহস্থালির তৈজসপত্র বিক্রি করেন জোবায়ের হাসান; মাঝে মহামারীর লকডাউনে পেটের টানে রিকশাও চালিয়েছেন কয়েক দিন। ঈদ নিয়ে বাড়তি কিছু ভাবার ফুরসত তার কই!

মেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2021, 04:18 AM
Updated : 12 May 2021, 04:18 AM

জীবনকে বাঁকিয়ে চুড়িয়ে কতটা কষ্ট সহ্য করে টিকে থাকা সম্ভব, তার সব পরীক্ষাই এই মহামারীর দিনে দিতে হচ্ছে জোবায়েরের মত খেটে খাওয়া মানুষদের।

জীবনের অনেক ঈদই তাদের জন্য খুশি নিয়ে আসেনি। কিন্তু এই মহামারীকালের সঙ্গে অন্য সময়ের তুলনা চলে না। বেঁচে থাকার অবিরাম সংগ্রামে সঞ্চয়হীন এই মানুষগুলোর কাছে মহামারী, লকডাউন বা ঈদের ভিন্ন কোনো অর্থ নেই।  

রোজার শেষভাগে এসে সোমবার ঢাকার শাহবাগ মোড়ে কথা হয় জোবায়েরের সঙ্গে। ট্রাফিক সিগনালে থামা বাসে বাসে উঠে ডাল ঘুটনি, সবজি কাটার যন্ত্রের মত ছোটখাট তৈজসপত্র বিক্রির চেষ্টা করছিলেন তিনি।

জিজ্ঞেস করতেই জোবায়ের বলছেন, পাঁচটা জিনিস একশ টাকা। কিন্তু সাংবাদিক বুঝে আগ্রহ হারালেন। তারপর ঈদ আর আয়-রোজগারের কথা তুলতেই তার কণ্ঠে ঝরল আক্ষেপ।

“আগে যখন করোনা ছিল না, দিনে সাতশ টাকা, এক হাজার টাকার বিক্রি হইত। এখন সারা দিনে দুইশ টাকার বেশি থাকে না। ঈদের জন্য বাড়তি কিছু ভাবা তো এখন বিলাসিতা।”

ভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে এপ্রিলের মাঝামাঝি সরকার যখন কঠোর বিধিনিষেধ দিল, ঢাকার রাস্তায় বাস চলা বন্ধ হয়ে গেল, গতবছরের লকডাউনের মত সেই কঠিন দিনগুলো আবার ফিরে এল জোবায়েরের জন্য। 

শাহবাগ মোড়ে ট্রাফিক সিগনালে তারা বাসের অপেক্ষায় থাকেন। কোনা বাস থামলে তাতে উঠে যাত্রীদের কাছে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির চেষ্টা করেন। লকডাউনে বাস যখন বন্ধ ছিল, রোজগারের এই উপায়ও ছিল না তাদের।

“আমার জীবনেও আমি যেই কাজ করি নাই, গ্রামের সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা দিয়া আমি ঢাকা শহরে চাইর দিন রিকশাও চালাইছি।”

জোবায়েরের সাথেই ছিলেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা মাহবুব আলম। ঢাকার বিভিন্ন রুটের বাসে টুথব্রাশ, চিরুনির মত খুচড়ো পণ্য ফেরি করেন তিনি। গাড়ি যখন বন্ধ ছিল, তার বেচাবিক্রিও বন্ধ ছিল।

“লকডাউনের মধ্যে জমানো কিছু টাকা ছিল, সেইগুলা ভাইঙ্গা সংসার চালাইছি। এরপরে একজনের কাছ থেইকা পাঁচ হাজার টাকা হাওলাদ করছিলাম। হাতে টাকা আইলে সেই টাকা শোধ দিতে হইব, ঈদ করমু কী দিয়া।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করেন বাদশাহ মিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, আর লকডাউনের কারণে রাস্তাতেও লোক কম। রোজার সময় দিনের বেলায় তার ব্যবসাও চলে না।

চোখেমুখে হতাশা নিয়ে বাদশাহ বলেন, “এক ফ্লাস্ক চা বানায়া আধা ফ্লাস্কই ফ্যালায়া দিতে হয়। রোজগার হইব কেমনে? আর ঈদই করুম কেমনে?”

অন্য সময় দিনে তিন-চার হাজার টাকা বিক্রি করে চার-পাঁচশ টাকা থাকত বাদশার। এখন এক হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি করতে পারলে এক-দেড়শ টাকা পকেটে থাকে।

সারাদিন রোজা রেখে শুধু এক গ্লাস পানি খেয়ে ইফতার করেছেন, এমন দিনও গেছে যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকায় সিটি পল্লী বস্তির রত্না আক্তার ও তার পরিবারেরর।

ধলপুরের সিটি পল্লী বস্তির আইরিন আক্তার আগে কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। সেই চাকরি হারিয়ে এখন বাড়িতে বাড়িতে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হয় তাকে।

পেশায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী রত্না জানালেন, ক্লিনিংয়ের কাজ করে মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় হয়। আবার সবসময় কাজও থাকে না। মা অসুস্থ, কাজ করার মত অবস্থা তার নেই।

দুই মাসের ঘর ভাড়া বাকি জানিয়ে রত্না বললেন “কয়দিন আগে বাবা একজনের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা ধার করছেন, সেটা দিয়ে চাল কিনলাম। ঈদের জন্য বাড়তি কোনো আয়োজন গত বছরও করতে পারিনি। এই বছর অবস্থা আরও বেশি খারাপ।”

একই বস্তির আইরিন আক্তার পোশাক কারখানার চাকরি হারিয়েছেন তিন মাস হল। আপাতত বাড়িতে বাড়িতে সিঁড়ি ঝাড়ু আর মোছার কাজ করে দুমুঠো ভাত তুলে দিচ্ছেন দুই ছেলে-মেয়ের মুখে।

দুই বছর আগে স্বামীহারা আইরিন বলেন, “যখন যেই কাজ পাই, তা কইরাই সংসার চালাই। করোনার কারণে কেউ কাজও দিতে চায় না। আমাগো ঈদ আসবে কই থেকে?”

ধলপুরে বৃদ্ধ মা আর দুই সন্তান নিয়ে থাকেন আনজিরা। বছর কয়েক আগে আগুনে শরীরের অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শ্রবণশক্তিও খানিকটা কমে যায়। ছেড়ে যান স্বামী।

সারাদিন রোজা রেখে শুধু একগ্লাস পানি খেয়ে ইফতার করেছেন, এমন দিনও গেছে  সিটি পল্লী বস্তির রত্না আক্তার ও তার পরিবারের।

প্লাস্টিক বোতল, পলিথিনসহ রাস্তাঘাট থেকে কুড়ানো বাতিল জিনিস বিক্রি করে এক-দেড়শ টাকা রোজগার ছিল আনজিরা বেগমের। লকডাউনে রাস্তা ফাঁকা থাকায় এখন আর কিছু পান না। তাই ভিক্ষা করেই সংসার চালাচ্ছেন।

ঈদের কথা জানতে চাইলে বলেন “ইফতারেই আমরা পানি খায়া থাকি, ভাত খাই একবেলা। এর মধ্যে আর ঈদ কই?”

পাঁচ মাস আগে চাকরি হারিয়েছেন একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মী মোক্তার আহমেদ। এরপর থেকে বাধ্য হয়ে রাইড শেয়ারিং অ্যাপে মোটর বাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। 

লকডাউনে ৩১ মার্চ থেকে বাইক সেবা বন্ধ থাকায় একমাস ঘরেই বসে ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার আবারও পথে বেরিয়েছেন।

মোক্তার জানালেন, অনলাইনে ছোটবোনের পোশাক বিক্রির আয় দিয়ে চলেছে তাদের চারজনের সংসার।

রাস্তাঘাট থেকে কুড়ানো বাতিল জিনিস বিক্রি করে চলতে হয় আনজিরা বেগমকে। লকডাউনে ফাঁকা রাস্তায় এখন কুড়ানোর মত জিনিসও থাকে না।

“এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কাউকে বলতেও পারছি না কোন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আমার পরিবার যাচ্ছে। এর মধ্যে ঈদের খুশিতে আনন্দিত হতে চাইলেও সেটা সম্ভব না।”

রাজধানীর গোড়ান টেম্পোস্ট্যান্ড থেকে গুলিস্তানগামী একটি লেগুনার চালকের সহকারী শাহেদ আলম। ‘লকডাউনে’ লেগুনা বন্ধ থাকার সময় বাবার সঙ্গে কয়েকদিন ভ্যানে সবজিও বিক্রি করেছেন।

সদ্য কৈশোর পেরুনো শাহেদ বললেন, “খুব কষ্টের মধ্যে ছিলাম। ঈদে মায়ের লাইগা একটা শাড়ি কিনছি জমানো চাইরশ ট্যাকা দিয়া। আর কারো লাইগা কিছু করতে পারি নাই।”