সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা নিয়ে ‘আদালত অবমাননার’ অভিযোগ

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘সৌন্দর্য বাড়ানোর নামে’ গাছ কাটা বন্ধে সরকারকে উকিল নোটিস পাঠানোর পর এবার ‘আদালত অবমাননার’ অভিযোগ করা হয়েছে হাই কোর্টে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2021, 07:22 AM
Updated : 9 May 2021, 11:13 AM

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ রোববার হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ওই আবেদন করেন।

‘আদালতের রায় উপেক্ষা করে’ উদ্যানের গাছ কাটায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামিম আকতার এবং স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি মীর মঞ্জুরুর রহমানের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না- সেই প্রশ্নে রুল চাওয়া হয়েছে ওই আবেদনে।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনজনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল চাওয়ার পাশাপাশি উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধ করা, রেস্তোরাঁ নির্মাণ কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি কোন প্রকল্পের অধীনে সরকার উদ্যানে কী কী কাজ করছে তার বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন হলফনামা করে আদালতে দাখিলের নির্দেশনা চেয়েছেন তিনি।

স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণে গণপূর্ত অধিদপ্তরের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু গাছ ইতোমধ্যে কাটা হয়েছে। কাটার জন্য আরও কিছু গাছ চিহ্নিত করা হয়েছে।

সেখানে ‘রেস্তোরাঁ ও হাঁটার পথ’ নির্মাণের জন্য গাছ কাটা হচ্ছে অভিযোগ করে এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। গত কয়েকদিন ধরেই সেখানে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন প্রতিবাদকারীরা।  

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলেছে, ঐতিহাসিক এই উদ্যানে ‘আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিকেন্দ্র’ গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘কিছু গাছ’ কাটা হয়েছে। গাছ কাটা নিয়ে ‘খণ্ডিত তথ্য’ প্রচার হওয়ায় জনমনে ‘বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে’।

আর প্রকল্প পরিচালক মো. হাবিবুল ইসলাম বলেছেন, “যখনই যেই গাছ কাটা পড়বে, সেই গাছের বিপরীতে ১০টা গাছ লাগানো হবে। আর সামগ্রিকভাবে অন্তত এক হাজার গাছ লাগানো আমাদের লক্ষ্য।”

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটার প্রতিবাদে ঝুলানো ব্যানারের সামনেই রোববার দুপুরে কাটা গাছের গুড়ি নিয়ে খেলায় মত্ত পথ শিশুরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

উদ্যানের ‘সৌন্দর্য বাড়ানোর নামে’ গাছ কাটা বন্ধের দাবি জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার সরকারের তিনটি দপ্তরে উকিল নোটিস পাঠান মনজিল মোরসেদ।

নোটিসে ২০০৯ সালে হাই কোর্টের দেওয়া রায় তুলে ধরে বলা হয়, “সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিছক একটি এলাকা নয়। এই এলাকাটি ঢাকা শহর পত্তনের সময় থেকে একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।

“এই এলাকার ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য আছে। শুধু তাই নয়, দেশের সকল গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র এই এলাকা। ফলে সম্পূর্ণ এলাকাটি একটি বিশেষ এলাকা হিসাবে সংরক্ষণের দাবি রাখে।”

দুই দিনের সময় দিয়ে নোটিসে বলা হয়েছিল, ‘রেস্তোরাঁ নির্মাণের জন্য’ গাছ কাটা বন্ধ করা না হলে বিবাদীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে।

তাতে সাড়া না পেয়ে রোববার হাই কোর্টে ‘আদালত অবমাননার’ অভিযোগ এনে এই আবেদন করেন মনজিল মোরসেদ। যে কোনো দিন এর ওপর শুনানি হতে পারে বলে জানান এই আইনজীবী।   

তিনি বলেন “গত ১১ বছর হাই কোর্টের ওই রায় বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পূর্ত মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। যখনই যোগাযোগ করেছি তখনই বলা হয়েছে, এ সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। 

“কিন্তু আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসলে কী হচ্ছে গত ১১ বছরেও আমরা জানতে পারিনি। এমনকি সংবাদ মাধ্যমেও এ সংক্রান্ত বিস্তারিত কিছু আসেনি। ফলে মনে হচ্ছে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করা হচ্ছে বা পাশ কাটানো হচ্ছে।”

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ’ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের মহাপরিকল্পনা

রায় বাস্তবায়ন নিয়েও উষ্মা ছিল উচ্চ আদালতের

এক সময় রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সেই ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানও এই উদ্যান।

ঐতিহাসিক ওই স্থান দুটি সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ২০০৯ সালের ২৫ জুন জনস্বার্থে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন।

এর এক বছর পর দেওয়া রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে শিশু পার্ক, মহানগর পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, ফুলের মার্কেটসহ একাত্তর পরবর্তী স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

আদালত রায়ে এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক সাতটি স্থান চিহ্নিত করারও নির্দেশ দিয়েছিল।

এর মধ্যে আছে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণের স্থান; ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান; একাত্তর সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথের স্থান; ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান; ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান; ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার দিনের ভাষণের স্থান এবং ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের স্থান।

এই সাতটি স্থান ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব ধরনের স্থাপনা সরিয়ে ফেলারও নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে।

গত বছর এ সংক্রান্ত আরেকটি রিট আবেদনের শুনানিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে ওই রায়ের আদেশ বাস্তবায়নের প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল।

পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করর্পোরেশন আদালতে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দেয়।

সেসব প্রতিবেদন দেখে গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিল, গত ১০ বছরে অন্য কোথাও শিশু পার্ক সরাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। ঢাকায় বাচ্চাদের খেলার জায়গা নেই বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়।

রায়ে বলা হয়, “আদেশ বাস্তবায়ন না করলে কোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হোক। শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্থানটি চিহ্নিত করার উদ্যোগ ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।”

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৬১০ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবেদার ইসলাম খাঁর সময়ে ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে উদ্যান গড়ে ওঠে তাই আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক।

ব্রিটিশ শাসনামলে এটি রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিতি পায়, পাকিস্তান আমলেও ছিল তাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়, আরেক অংশ হয় রমনা পার্ক।

প্রায় দুই কোটি মানুষের নগরী রাজধানী ঢাকার ‘ফুসফুস’ হিসেবে বিবেচিত এই দুই উদ্যান।