ঈদ বাজারে স্বাস্থ্যবিধি শিকেয়, দায় কার?

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুরোধ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান কিছুতেই কাজ হচ্ছে না; ঢাকায় ঈদ বাজারে ভিড় বাড়ছেই, আর সেই ভিড়ে স্বাস্থ্যবিধি উঠেছে শিকেয়।

সাজিদুল হকও কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2021, 05:51 PM
Updated : 8 May 2021, 06:46 PM

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে লকডাউন দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে শর্ত সাপেক্ষে দোকানপাট খুললেও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঈদ কেনাকাটায় এবারের জন্য লাগাম দিতে অনুরোধ করেছিলেন।

কিন্তু তা উপেক্ষা করেই ঝুঁকি নিয়ে ঈদের কেনাকটায় মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে রাজধানীর বিভিন্ন বিপণি বিতানে; সামাজিক দূরত্ববিধি মানা, মাস্ক পরার নির্দেশনা তোয়াক্কা না করেই।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনীচক, বসুন্ধরা সিটি, সুবাস্তু শপিং কমপ্লেক্সে ঘুরে দেখা যায় মানুষের ঢল। বিক্রেতারা বলছেন, শুক্রবার ভিড় ছিল তারও বেশি।

দোকানিরা বলছেন, মাস্ক পরার কথা বললেও অনেক ক্রেতাই তা শুনছেন না। ক্রেতাদের অনেকেই বলছেন, গরমে হাঁসফাস লাগে বলে মাস্ক খুলে রাখছেন তারা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মুখে মাস্ক থাকলেও সামাজিক দূরত্ব ছিল না।

নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে হ্যান্ড মাইকে স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি মানতে বারবার ঘোষণা দেওয়া হলেও ক্রেতাদের অনেকেই মাস্ক ছাড়াই ঘুরছিলেন। কথা বলতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে অনেকেই যাচ্ছিলেন এড়িয়ে।

নিউ মার্কেটের বাইতুল আমান জামে মসজিদ মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী মো. শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাস্ক ছাড়া মার্কেটে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু দোকানে এসে ক্রেতারা মাস্ক খুলে ফেলেন। জিজ্ঞাসা করলে নানা অজুহাত দেয়। তাহলে আমাদের কী করার আছে?

“আমাদের দোকানের মালিক-কর্মচারী সবাই মাস্ক পরে থাকি। এমনকি একটু পর পর স্যানিটাইজও করি।”

নিউ মার্কেটের নিরাপত্তা প্রহরী মোহাম্মদ শাহিদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বারবার ঘোষণা করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমরা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। বারবার ঘোষণা দিচ্ছি। বিভিন্ন গেইটে কাউকে মাস্ক ছাড়া প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।”

রূপান্তর ক্লথস’র মালিক মোহাম্মদ সোহান বলেন, “আমরা সবাইকে হ্যান্ড মাইক দিয়ে বারবার বলছি যে মাস্ক পরার জন্য। কিন্তু অনেকেই ব্যবহার করছে না।”

এই দোকানেই দেখা গেল তিনজন কর্মচারীর মাস্ক ছাড়া। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সোহান বলেন, “এ গরমে কতক্ষণ মাস্ক দিয়ে টেকা যায়। তাই কিছুক্ষণের জন্য খুলে রেখেছি।”

নিউ সুপার মার্কেটের দোতলায় উঠতেই দেখা যায় নিরাপত্তা প্রহরীরা যাদের মাস্ক নেই তাদেরকে আটকে দিচ্ছে।

দোতালার নিরাপত্তা প্রহরী মো. মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছে না। আমরা তাদেরকে ঢুকতে দিচ্ছি না। তারপরও এদিক-সেদিক দিয়ে অনেকেই ঢুকে যায়। আর সামাজিক দূরত্বের কথা বললেও কেউ সেটা মানছে না।”

নিউ মার্কেটের দোতালায় টোকিও ফ্যাশনের মালিকসহ চার কর্মচারী কারও মুখেই মাস্ক ছিল না। কথা বলতে গেলে তারা তাড়াতাড়ি মাস্ক পরে নেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না বলে তারা জানিয়ে দেন।

মাস্ক না থাকা কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলতে চাইল সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা এড়িয়ে যান।

গাউছিয়া মার্কেটের নিচতলায় ব্যবসায়ী শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্রেতাদের মাস্ক এর বিষয়ে বেশি কিছু বললে দোকান থেকে বের হয়ে যায়। এই কারণে বললে আমাদেরই ক্ষতি।”

নিচতলার আরেক দোকানে গিয়ে দেখা যায় মালিক কর্মচারীসহ চারজনের মাস্ক থুতনির নিচে। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা কোন কথা বলতে চাননি।

চাঁদনী চক মার্কেটের দোতালায় ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতাদের বেশিরভাগের মুখেই মাস্ক নেই। আর এরজন্য গরমকে দায়ী করছেন তারা।

সুমাইয়া আফরিন মাস্ক না পরার বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি সব সময় মাস্ক পরি। এখন আমার ব্যাগের ভেতরে মাস্ক রয়েছে। তবে মার্কেটের ভিতর প্রচণ্ড গরমের কারণে মাস্ক খুলে ফেলতে বাধ্য হয়েছি।”

চাঁদনী চক মার্কেটের দোতলার ব্যবসায়ী সৌমেন্দ্রনাথ মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ক্রেতাদের সব সময় মাস্ক পরার অনুরোধ করি। তবে কেউ আমাদের কথা শোনেন না। বেশি অনুরোধ করলে দোকান থেকে বের হয়ে যান।”

নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বাস্থবিধি মানানোর জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। গেটগুলো দিয়ে মাস্ক ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রত্যেক গেইটে জীবাণুনাশক টানেল দিয়ে স্প্রে করা হচ্ছে।”

এদিকে শুক্রবারের মতো না হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা সিটিতে ক্রেতাদের চাপ বাড়তে থাকে। ঢোকার মুখে প্রত্যেকের শরীরের তাপ পরিমাপ করা হলেও সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে দূরত্ববিধি মানা হয়নি। জীবাণুমক্ত চেম্বারের ভেতর দিয়ে ঢুকে হাত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করেই সবাইকে ঢুকতে হচ্ছিল।

গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে মার্কেটে ঢোকার পর একটু ফাঁকা জায়গায় সবাই দাঁড়াতে পারলেও এক্সেলেটরের মুখে আবারও ছিল ভিড়। মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মীরা খানিক বিরতি দিয়ে ক্রেতাদের উঠতে দিলেও সেটা সবসময় করা হচ্ছিল না। নিচের তলার এক্সেলেটরের সামনে এরকম ব্যবস্থা থাকলেও বিপণিবিতানের অন্য তলাতে এই ব্যবস্থা ছিল না।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে এক নিরাপত্তাকর্মী নাম প্রকাশ করতে না চেয়ে বলেন, “আমরা তো সবসময় বলছি। কিন্তু মানুষ না মানলে কী করতে পারি?”

মার্কেটের প্রথম তলাতেই হ্যান্ড মাইককে সবাইকে সচেতন করা হচ্ছিল, কিন্তু তা মানতে দেখা যাচ্ছিল না কাউকে। মাস্ক ছাড়া সেরকম কাউকে চোখে না পড়লেও অনেকেই সঠিকভাবে মাস্ক না পরে নামিয়ে রাখছিলেন।

জিজ্ঞেস করলে এক ক্রেতা একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, “ভাই অন্য কাজ নেই। সাংবাদিক বলে কি সব কিছু নিয়ে লিখতে হবে?” ওই ক্রেতার সঙ্গে থাকা একজন বলেন, “মাস্ক তো আছে। একটু সময়ের জন্য নামিয়ে রেখেছি।”

বসুন্ধরা সিটির অনেক দোকানেই দূরত্ববিধি মেনে চলার ব্যাপারে নির্দেশনা এবং চিহ্ন করে রাখা থাকলেও ক্রেতাদের তা মানতে দেখা যায়নি। কিছু কিছু দোকানের ক্যাশকাউন্টারের সামনে দূরত্ব বিধি মানার জন্য দোকানের কর্মীরা বারবার নির্দেশনা দিচ্ছেন।

ইজি ফ্যাশনের বিক্রয় কর্মী মো. নঈম বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি ক্রেতারা যাতে মাস্ক পরে থাকেন। অনেকেই সেটা মানতে চায় না। তখন আমাদের কিছুই করার থাকে না।”

বসুন্ধরার ৫ তলার এক কোনায় কয়েকজনকে মাস্ক ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে রিয়াদুজ্জামান নামের একজন বলেন, “আমরা বন্ধু। প্রায় সবসময় একসাথেই থাকি। আর এসির মধ্যে আসলে মাস্ক ছাড়া বেশিক্ষণ থাকা যায় না।”

এসির মধ্যে মাস্ক পরে থাকলে কী সমস্যা হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভারী বাতাস। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাই একপাশে দাঁড়িয়ে বন্ধুরা মিলে গল্প করছি।”

এদিন দুপুর দেড়টার দিকে আদেল প্লাজার আড়ংয়ের শো রুমে ঢুকে দেখা যায়, ক্যাশ কাউন্টারে সবাই দূরত্ববিধি মেনে দাঁড়ালেও পণ্য দেখে পছন্দ করার সময় তা একদমই মানা হচ্ছে না। দোকানের কর্মীরা ক্রেতাদের বারবার সেটা মনে করিয়ে দিলেও ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। 

আড়ংয়ের নিরাপত্তাকর্মী ইব্রাহিম বলেন, “আজকে ভিড় কম। গতকাল আমরা ক্রেতাদের দাঁড় করিয়ে রেখে রেখে ঢুকতে দিয়েছি। কিছু মানুষ বেরোলে তারপর কিছু মানুষকে ঢুকতে দিয়েছি।”

রাজধানীর শাহজাদপুরের সুবাস্তু শপিংমলে দেখা গেছে, মাস্ক ছাড়া অনেকেই ভেতরে ঢুকছে। অন্য দিনের তুলনায় শনিবার ভিড় একটু কম বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

সুবাস্তু শপিংমলের কাপড়ের ব্যবসায়ী তৌফিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি। ভিড় বেশি থাকলে স্বাস্থ্যবিধি মানা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্রেতারাই মাস্ক পরছেন, কেউ কেউ পরে না, তাদের আমরা সুযোগ বুঝে বলি। না শুনলেও আমরা বেশি কিছু বলি না।”

ধানমন্ডির প্লাজা এ আর, রাপা প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে ঢোকার মুখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশিকা থাকলেও অনেক ক্রেতাই ভিতরে ঢুকে মাস্ক খুলে ফেলছেন।