নিরন্ন মানুষের খাবারের ঠিকানা ‘মেহমানখানা’

মহামারী আর ‘লকডাউনের’ মধ্যে নিরন্ন মানুষের ভরসা হয়ে উঠেছে ঢাকার লালমাটিয়ার ১১ তরুণের উদ্যোগ ‘মেহমানখানা’।

আফরিন মিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2021, 01:24 PM
Updated : 6 May 2021, 01:24 PM

গতবছরের মত এবারও রোজায় প্রতিদিন ইফতার নিয়ে হাজারো মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন তারা। বছর পেরুনো এই উদ্যোগের চাকা ঘোরাতে এবার হাত বাড়িয়েছেন আরও অনেকে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, শ্রেণি, পেশা কিংবা বিত্তের বিচার নয়, যারা আসেন ‘মেহমানই’ তাদের পরিচয়। এমন মনোভাব নিয়েই লালমাটিয়ার ডি ব্লকে চলছে তাদের কাজ।

ইফতারে ছোলা, মুড়ি, খেজুর, চিড়া, জিলাপির সাথে থাকে শরবত। শুক্রবার হয় বিশেষ খিচুরি। কেউ আগে থেকে জেনেই আসেন, আবার কেউবা শরিক হয়ে যান চলতি পথে।

বেলা গড়াতেই সেখানে শুরু হয় বিশাল আয়োজন। সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে এলেই কেউ প্লেট নিয়ে, কেউবা পলিথিন হাতে হাজির হয়ে যান ‘মেহমানখানা’য়। রাস্তার পাশে ফুটপাতে সারি বেঁধে চলে তাদের ইফতার।

আয়োজকরা জানালেন, প্রতিদিন তারা এক হাজার মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। তবে মেহমানের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হয় মাঝেমধ্যেই। তখন ওই খাবারেই চালিয়ে নিতে হয়। 

সোমবার সন্ধ্যায় ইফতারের আগে আগে মেহমানখানার দুয়ারে সামাজিক দূরত্ব মেনে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন লালমাটিয়ার একটি বাসার নিরাপত্তাকর্মী মঞ্জুর মিয়া।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “আমি গতবছরও এখান থেকে ইফতার নিছি, এবারও নিতেছি।”

ঢাকার লালমাটিয়া এলাকায় শুক্রবার ‘মেহমানদের’ ইফতার বিতরণ করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

অন্ধ মাকে নিয়ে ভিক্ষা করে বাড়ি ফিরছিলেন আয়েশা খাতুন। পথে দাঁড়িয়ে যান মেহমানখানার ইফতারের লাইনে।

তিনি বললেন, “সারাদিন রোজা রাইখা ইফতার কি করমু তার ঠিক ছিল না। রাস্তা দিয়া যাওনের সময় দেখলাম, আমি আর মা দাঁড়ায় গেছি।”

এই লাইনে পথশিশুদেরও দেখা গেল। তাদেরই একজন বললো: “এইখানে সেইদিন খিচুড়ি খাইছি। আজকেও আসছি। ভালো লাগে এইখানে খাইতে।”

রিকশাওয়ালা, দিন মজুর, নিরাপত্তাকর্মী, ভিক্ষুক কিংবা খেটে খাওয়া সামান্য আয়ের মানুষেরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ইফতারের জন্য আসেন এখানে।

 

‘মেহমানখানা’ নামে এ উদ্যোগের যাত্রা শুরু গতবছর করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে চলা লকডাউনের সময়। তখনও ছিল রোজার মাস। লালমাটিয়ার ১১ জন তরুণ-তরুণীর উদ্যোগে চালু হয় নিরন্ন মানুষের এই খাবারের ঠিকানা।

বছর ঘুরে এবার কোভিডে- ১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। তার মধ্যেই এসেছে রমজান মাস; চলছে ‘লকডাউন’। মেহমানখানাও চলছে অসহায়ের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার ব্রত নিয়ে।

আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গে শুক্রবার লালমাটিয়ায় ইফতার শুরু করেন ‘মেহমানরা’। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

যাদের উদ্যোগে মেহমানখানার শুরু, তাদের পুরোভাগে রয়েছেন আছমা আক্তার লিজা ও সৈয়দ সাইফুল ইসলাম শোভন। লালমাটিয়ার ডি ব্লকে যে বাড়ির সামনে মেহমানখানা বসে, সেখানেই তারা থাকেন।

তারা জানালেন, প্রতিদিনের আয়োজনে কম-বেশি ৩০ হাজার টাকা লেগে যায়। এর যোগান আসে তাদের পরিচিত-অপরিচিত নানা মাধ্যম থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অনেকে টাকা পাঠিয়ে দেন। তাদের ১১ জনের সঙ্গে আরও অনেকে এখন মেহমানদারিতে যুক্ত হয়েছেন।

শুরুর সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে ৩৬ বছর বয়সী নাট্যকর্মী লিজা বললেন, “সমস্ত শহরটা (লকডাউনে) স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভেতর থেকে কী যেন অনুভব করলাম। তখন আমরা ভাইবোন আর হাজবেন্ড মিলে শুরু করলাম। নিভৃতে সবাই সাহায্য করতে শুরু করল।”

তখন রোজা ছিল বলে এক মাস ইফতার খাওয়ানো হল মেহমানদের। পরে আরও একমাস খাওয়ানো হল রাতের খাবার। হাসপাতালে রোগীর খাবারও যুগিয়েছে মেহমানখানা।

টাকার কারণে এরপর প্রতিদিন এ আয়োজন চালানো সম্ভব না হলেও গত একটি বছর প্রতি শুক্রবারে ঠিকই মেহমানখানায় রাতের খাবার পেয়েছে ক্ষুধার্ত মানুষ। 

লিজা বলেন, “আমাদের প্রায় প্রতিদিনই বন্ধ হয়ে যায়, হয়ে যায় ভাব। গত এক বছরে মনে হত কাল সকালে কী করব? কীভাবে চুলাটা জ্বালব, বাচ্চাগুলো এসে বসে থাকবে।”

ঢাকার লালমাটিয়া এলাকায় শুক্রবার ‘মেহমানদের’ জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে খাবার। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তারপরও কোনো না কোনো উপায় হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বললেন, এ কাজে এখন উৎসাহ নিয়ে যোগ দিয়েছেন নানা বয়স আর নানা পেশার অনেকে।

মহামারীতে স্কুল বন্ধ্ থাকায় এখানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছে ১০ বছরের মিম। শিশুর স্বাভাবিক সরলতায় সে বললো: “আমি এখানে সবার সাথে কাজ করি। রিকশাচালক, বয়স্ক লোক যারা আসে, তাদের সেবা করতে ভালো লাগে আমার।”

উদ্যোক্তাদের আরেকজন এনজিওকর্মী সাইফুল আলম শোভন (৩৮) বললেন, প্রতিনিয়ত যারা নরবাসীকে শ্রম আর সেবা দেয়, সেই মানুষগুলোকে এই সঙ্কটের দিনে সেবা দিতেই তিনি মেহমানখানায় যুক্ত হয়েছেন।

“এই শহরটাই এমনভাবে গড়ে উঠেছে, এই মানুষগুলো ছাড়া এই শহরটাতে আমরা যেমন টিকে থাকতে পারব না, তেমনি এই সংকটের সময়ে আমরা এগিয়ে না এলে এই মানুষগুলোর জীবন অনেক কঠিন হয়ে যাবে।”