এখন সময়-সুযোগ অনুযায়ী একেক রকম কাজ করে সংসার বাঁচানোর চেষ্টায় আছেন হাসান আলী।
ঢাকার পল্লবীর এই বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছর থেকেই ইনকাম নাই। টুকটাক কাজ পাইলেও আগের মতো মজুরি দেয় না। জমানো কিছু টাকা ছিল, সেগুলা আগেই শেষ। এখন বইসা থাকার চেয়ে কিছু না কিছু করা তো ভাল।”
হাসান আলীর মতো অনেক শ্রমিকের ভাগ্যেই অনিশ্চয়তা নিয়ে এসেছে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ।
এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকের অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক দিবসটি (মে দিবস) ধূসর হয়ে এসেছে দেশের কোটি শ্রমিকের সামনে।
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে শ্রমের মর্যাদা এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকদের আত্মাহুতি স্মরণে বিশ্বজুড়ে ১ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।
তবে দেশে লকডাউনে এবার কর্মহীন থাকতে হচ্ছে অসংখ্য শ্রমিককে, সরকারি বিধিনিষেধ যত দীর্ঘ হচ্ছে তাদের বিপদও তত বাড়ছে। এর মধ্যে গণপরিবহন চালুর দাবিতে রোববার দেশব্যাপী বিক্ষোভ ডেকেছে সড়ক পরিবহন শ্রমিকরা।
পরিবহন শ্রমিক সাব্বির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো দিন আনি দিন খাই। এভাবে লকডাউন চললে পেট চলবে কেমনে? গতবছরও অনেকদিন কোনোমতে বাইচ্চা ছিলাম।
“এবারও ভয় পাইছিলাম। ইন্ডিয়ার মতো হইলে তো না খেয়ে মরতে হবে ভাবছিলাম। কিন্তু এখন তো কমে গেছে করোনাভাইরাস। গাড়ি ছাড়া উচিৎ। তাইলে আমাদের পেটও চলবে।”
পুরান ঢাকার চানখারপুলের জুতার কারখানার কর্মী জুবায়ের এক বছর ধরে কর্মহীন। নতুন করে কাজ শুরুর আশায় থাকা এই তরুণ বলেন, “জুতার কাজটা মাত্র শেখা শুরু করছিলাম। এরপরই সব শেষ। এখন আর কাজ পাই না। সামনে দেহি কপালে কী আছে।”
মহামারী সঙ্কুচিত করেছে দেশের শ্রম বাজার। কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কাটছাঁটের খবর আসছে নানা স্থান থেকে। নতুন নিয়োগ কমে যাওয়ায় চাকরি হারানো অসংখ্য মানুষের সামনে কাজের সুযোগও আসছে খুবই কম। ফলে চাকরির আশায় থাকা শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত কর্মীদের সামনেও দিশা নেই।
গত ১৭ এপ্রিল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, মহামারীর প্রভাবে দেশে কাজ হারিয়েছেন মোট শ্রমশক্তির ৩ শতাংশের বেশি। আর নতুন করে দরিদ্র বেড়েছে দেড় কোটি।
২০২১ সাল শেষ হতে হতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মহীন হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।
এর সাথে যোগ হয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের কাজ হারানোর ধাক্কাও। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জানুয়ারিতে সংসদে জানিয়েছিলেন, মহামারীর মধ্যে গত বছর ৪ লাখ ৮ হাজার ৪০৮ জন কর্মীকে দেশে ফেরত আসতে হয়েছে।
ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেরত আসা শ্রমিকদের ৪৭ শতাংশ এক বছরেও কোনো কাজ জোটাতে না পেরে ধার-দেনা করে চলছে।
মহামারীকালে শ্রমিকরা যে ‘অন্তহীন দুর্ভোগে’ পড়েছে, সেই চিত্র তুলে ধরে শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার বলেন, “শ্রমজীবী মানুষ কাজ না পাওয়ার ফলে কঠিন জীবনযাপন করছে। এরকম পরিস্থিতি মে দিবসে আমাদের কাম্য না। আমরা মনে করি, সরকার এবং মালিকদের গাফিলতির কারণে এটা হয়েছে।”
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার মধ্যেও শ্রমিকদের কারাখানায় নেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “কারখানা খুলে রেখে শ্রমিকদের উপর বিরাট একটা অন্যায় ও অবিচার হয়েছে।
“আমরা যাদের ফ্রন্টলাইনার বলছি, তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম ভূমিকা রাখেনি শ্রমিকরা। তাদের ঝুঁকি ভাতা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এসব কিছু না করেই কারখানা খুলে রাখা হয়েছে।”
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, “গার্মেন্টসে এখন কাজের চাপ অনেক বেশি। তারা শ্রমিকদের খাটাচ্ছেও বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় কারখানাগুলোতে কোনো ধরনের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নাই।”
অর্থনীতি গবেষক ড. আতিউর রহমান মনে করেন, মহামারীর এই সময়ে শ্রমজীবী মানুষরা বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে।
তবে কারখানা চালু রাখার প্রশংসা করে তিনি বলেন, “গার্মেন্টস, মেগা প্রকল্প ও অবকাঠামোর কাজগুলো চালু রাখায় অনেক শ্রমিক কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজটা চালিয়ে যেতে হবে। এতে শুধু দেশের লাভ হবে তাই না, কর্মসংস্থানের যে অভাব সেটা অন্তত কম হবে।”
যেসবক শ্রমিকরা বেশ বিপদে পড়েছে, তাদের কাছে কিছু অর্থ ও খাদ্য সহযোগিতা পৌঁছানোর উপর জোর দেন আতিউর।
তিনি বলেন, “সরকার তার মতো করে চেষ্টা করছে। তবে সামাজিত সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতাগুলোর পরিমাণ বাড়াতে হবে।
“কিন্তু সমাজের অনেক কাজ আছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মতো শত শত উদ্যোগ নিতে হবে, যেন কর্মহীন মানুষগুলো অন্তত একবেলা খেতে পারেন।”
তবে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান দাবি করেছেন, শ্রমিকদের সামনে মহামারী যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে, তা সামলাতে সরকার তৎপর রয়েছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রমবাজারে যে শঙ্কা রয়েছে, সেটা কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়ে আমরা নজর দিচ্ছি। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে আমরা কমিটি করে দিয়েছি আগেই, তারা কাজ করছে।
“কোনো শ্রমিককে যেন ছাঁটাই করতে না পারে, ছাঁটাই করলেও তাদের যেন পাওনা পরিশোধ করা হয়; সেটা আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।”