মুনিয়ার মৃত্যু: ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় পুলিশ

কলেজছাত্রী মোসারত জাহান মুনিয়া ‘প্ররোচিত হয়েই আত্মহত্যা করেছেন’- এমন প্রাথমিক সন্দেহের ভিত্তিতেই তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের কথা জানিয়েছে পুলিশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 April 2021, 04:41 PM
Updated : 29 April 2021, 04:57 PM

আর সেজন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ কমিশনার সুদীপ চন্দ্র চক্রবর্তী।

গত সোমবার রাতে গুলশানের একটি ভবনের ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের পর বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনার’ অভিযোগে মামলা করে এই তরুণীর পরিবার।  

এজাহারে বলা হয়েছে, সায়েম সোবহান আনভীর ‘বিয়ের প্রলোভন’ দেখিয়ে মুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু বিয়ে না করে তিনি উল্টো ‘হুমকি’ দিয়েছিলেন মুনিয়াকে।

‘আত্মহত্যায় প্ররোচনার’ মামলা করলেও মুনিয়ার বড় বোন মামলার বাদী নুসরাত জাহান বলে আসছেন, এটা আত্মহত্যা, নাকি হত্যা- সেটা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।

এজাহারে তিনি লিখেছেন, মুনিয়ার দেহ শোবার ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ঝুলছিল। পা ‘খাটের উপর লাগানো এবং সামান্য বাঁকানো’ অবস্থায় ছিল।

উপ কমিশনার সুদীপ বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুনিয়ার মৃতদেহ আমরা ঝুলন্ত অবস্থায় পাই। সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার সন্দেহ হওয়ায় সেভাবেই আমরা মামলা নিই।

“এখন আত্মহত্যায় প্ররোচনার বিষয়টি প্রমাণের জন্য প্রয়োজন তথ্য-উপাত্ত। সেটার দিকে এখন আমাদের নজর।”

বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় ‘প্ররোচনার’ অভিযোগ এনেছে মুনিয়ার পরিবার।

তদন্তে কী পাওয়া গেছে- জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “মুনিয়ার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। দীর্ঘক্ষণ শরীর ঝুলে থাকার কারণে যেসব নমুনা, তা দেখা গেছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পর পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।”

মুনিয়ার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ বলেছে, “নাক স্বভাবিক ছিল, চোখ বন্ধ ছিল, তবে জিহ্বা আধা ইঞ্চি বাইরে দাঁত দিয়ে কামড়ানো ছিল। জিহ্বায় সামান্য লালাও দেখা গেছে, গলার বাম পাশে কালো দাগ রয়েছে, আর হাত অর্ধমুষ্ঠি অবস্থায় ছিল। যৌনাঙ্গ দিয়ে লালচে রংয়ের পদার্থ বের হতে দেখা গেছে, মলদ্বার স্বাভাবিক ছিল।”

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ওই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা, বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে- এসবি বিষয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে চাওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে উপ কমিশনার সুদীপ চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, “ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পর পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আজ পর্যন্ত আমরা প্রতিবেদন পাইনি।”

মুনিয়া ঢাকার একটি কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি কুমিল্লায়; পরিবার সেখানেই থাকে। মাস দুয়েক আগে এক লাখ টাকায় গুলশানের ওই ফ্ল্যাট তিনি ভাড়া নেন। সেখানে তিনি একাই থাকতেন।

গত সোমবার মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ ওই ফ্ল্যাটের সিসি ক্যামেরার ভিডিও এবং মুনিয়ার ব্যবহৃত ডিজিটাল ডিভাইসগুলো জব্দ করে।

সুদীপ চন্দ্র চক্রবর্তী বুধবার বলেছিলেন, ওই ফ্ল্যাটে যে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের যাতায়াত ছিল, সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে তার প্রমাণ মিলেছে। তবে ঘটনার দিন তার যাওয়ার কোনো প্রমাণ সেখানে পাওয়া যায়নি।

মুনিয়ার ব্যবহৃত ছয়টি ডায়েরিও পুলিশ আলামত হিসেবে জব্দ করেছে, যেগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে বলে তদন্তকারীদের ধারণা।

তারা বলছেন, মুনিয়া আত্মহত্যা করে থাকলে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। মামলার অভিযোগের ভিত্তিতে সেই কারণটিই তারা খুঁজছেন।

এদিকে মুনিয়ার বড় বোনের করা মামলায় পিয়াসা নামে এক নারীর কথা এসেছে। এজাহারে বলা হয়েছে, মুনিয়া ও আনভীরের ‘প্রেমের সম্পর্কের কথা’ জানতে পেরে আসামির মা সেই পিয়াসার মাধ্যমে ডেকে নিয়ে ‘ভয়ভীতি’ দেখিয়েছিলেন মুনিয়াকে। 

পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পিয়াসা হলেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের সাবেক পুত্রবধূ ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। একসময় তিনি এশিয়ান টিভির পরিচালক ছিলেন।

কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী’ বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে গ্রেপ্তারের দাবিতে গত কয়েক দিন ধরেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন।

বৃহস্পতিবার বিকালে পিয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুনিয়াকে চেনার কথা এবং আনভীরের মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পিয়াসা বলেন, “আনভীরের পরিবারের সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের পরিবারিক বন্ধন। মুনিয়াকে কখনোই ভয়ভীতি দেখানো হয়নি, বরং তার ভালোর জন্য আনভীরের মায়ের সামনে নিয়ে তাকে বোঝানো হয়েছে।”

পিয়াসার ভাষ্য, মুনিয়ার ‘ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে’ তাকে বোঝানোর যে দায়িত্বটা তার বড় বোনের ছিল, সেই কাজটা তিনি নিজে করেছেন।

“আনভীর একজন বিবাহিত ছেলে, তার কাছ থেকে সরে যেতে মুনিয়াকে বোনের মত করে বহুবার বোঝানো হয়েছে।”

মামলায় নাম থাকলেও পুলিশের কেউ এখনও কোনো ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করেননি বলে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান পিয়াসা।

মামলা হওয়ার পর গত মঙ্গলবার পুলিশের আবেদনে আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত।

তার আগেই তিনি দেশ ছেড়ে থাকতে পারেন, এমন গুঞ্জনের মধ্যে বুধবার তার পক্ষে আগাম জামিন চেয়ে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চে আবেদন করা হয়। তবে মহামারীর এই পরিস্থিতিতে আগাম জামিনের শুনানি করা হবে না বলে বৃহস্পতিবার জানিয়ে দিয়েছে ওই বেঞ্চ।