রানা প্লাজা: অভিযোগ গঠনের ৫ বছরেও শুরু হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ

আট বছর আগে মামলা, অভিযোগ গঠনেরও প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল; তবুও সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2021, 07:10 PM
Updated : 23 April 2021, 07:25 PM

এর মধ্যে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর তারিখ পিছিয়েছে ২৫ বারের মত। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন মামলাটিতে আগামী ৫ মে আবার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন রয়েছে।

তবে মামলাটির কার্যক্রমের ওপর দুই আসামী হাই কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রাখায় এটির বিচার শুরুর প্রক্রিয়ার জট এখনও খোলেনি। এতে হত্যা মামলাটির বিচার থেমে আছে।

মামলা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তারাও সুস্পষ্ট করে বলতে পারছেন না, কবে নাগাদ ৩৯ জন আসামির মধ্যে মাত্র দুই জনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন যদিও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি নিয়ে হাই কোর্ট খোলার প্রথম দিনই আমি মেনশন করব। আমার দরকার দুই আসামির পক্ষে রিভিশন মামলার নম্বর।“

এর মধ্যে রানা প্লাজার ভবন মালিক সোহেল রানা জামিনের চেষ্টা করছেন। গত বছর নভেম্বরে নিম্ন আদালত থেকে জামিন না পাওয়ায় তিনি হাই কোর্টে জামিন আবেদন করেন।

বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ২১ মার্চ তাকে কেন জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে। চার সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রকে জবাব দিতে বলেছে।

মামলার গেরো না খোলার এমন পরিস্থিতিতে শনিবার বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার আট বছর পূর্ণ হচ্ছে।

বিচারের এমন দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে সোচ্চার কর্মীরা। তারা এ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে স্থানান্তর না করারও সমালোচনা করেন।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এই শিল্প দুর্ঘটনার দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল । সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আট তলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন; প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও হাজারখানেক গার্মেন্ট শ্রমিককে।

ঘটনার দিনই সাভার থানায় দুটি মামলা হয়। পরের বছর দুর্নীতি দমন কমিশন দায়ের করে আরেকটি মামলা।

প্রথমটিতে হতাহতের ঘটনা উল্লেখ করে ভবন ও কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন সাভার মডেল থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ।

রাজউক কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের দায়ের করা অন্য মামলাটিতে ভবন নির্মাণে ত্রুটি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়।

বর্তমানে
হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি মো. মিজানুর রহমান শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, অভিযোগ গঠনের পর আটজন আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিতের আবেদন করেন। তাদের মধ্যে ছয়জনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। দুই আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাত উল্লাহ এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষের আবেদন এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

তিনি বলেন, “তাদের আবেদনের ফলে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে চারবার চিঠি দেয়া হয়েছে। তাই মামলার বিচার প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।“

এই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি খন্দকার আব্দুল মান্নান চলতি বছরের প্রথম দিকে মারা যাওয়ার পর তার জায়গায় দায়িত্ব প্রাপ্ত হন মিজানুর রহমান।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও আইন পেশাজীবী পারভেজ হাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি জনগুরুত্বসম্পন্ন, এ কারণে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে নিয়ে বিচারের জন্য বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করা উচিত ছিল।”

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি আইনজীবী মন্টু ঘোষ দ্রুত হত্যা মামলার বিচারের দাবি জানান।

তিনি এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে মামলার বর্তমান অবস্থা জানার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনার কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে দুই আসামির স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার বিষয়ে আমরা আপিল বিভাগে যাব।“

শনিবার নিহত শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানাতে তারা কবরে পুস্পার্ঘ অপর্ণ করতে যাবেন বলে বলে তিনি জানান।

মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু না হওয়ায় হতাশার কথা জানিয়েছেন আসামি সোহেল রানার আইনজীবী ফারুক আহাম্মদও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলাটি রাষ্ট্রপক্ষ আমার মোয়াক্কেলের বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে পারবে না। কেননা রানা ওই ভবনের মালিক ছিলেন না। বরং মালিক ছিলেন তার বাবা মা। অবহেলা থাকলে তাদের রয়েছে। দায় তাদের ঘাড়ে পড়ে। আমার মক্কেলর নয়। মামলাটি দ্রুত বিচার হলে আমরা লাভবান হতাম।“

‘অবহেলা ও অবহেলাজনিত হত্যার’অভিযোগে মামলা দায়েরের দুই বছর পর ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে।

আসামিদের আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যাওয়ায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৯ জন।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

আসামিদের মধ্যে মো. শাহ আলম মিঠু, মো. আবুল হাসান ও সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনির বিরুদ্ধে প্রধান আসামি সোহেল রানাকে পালাতে সহযোগিতা করায় জন্য দণ্ডবিধির ২১২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। বাকি ৩৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ গঠন করা হয়।

সোহেল রানা কারাগারে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন মাহবুবুর রহমান, কামরুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম, রেজাউল করিম, নান্টু কন্ট্রাকটর ও নয়ন মিয়া।

রানার বাবা আব্দুল খালেক ও মা মর্জিনা বেগমসহ বাকি আসামিরা জামিনে রয়েছেন।

রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলাটিতেও সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল।

অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে পদক্ষপ নেয়া হচ্ছে না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করেছেন। রিভিশন মামলাটির আদেশ না পাওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। তারিখের পর তারিখ চলে যাচ্ছে।”

নথিপত্রে দেখা যায়, রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিনের করা এই মামলায় ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। প্রায় দুই বছর আগে অভিযোগ গঠনও হয়েছে।

দুর্ঘটনার পর যে কয়েকটি মামলা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাজা হয়েছে রানা ও তার মায়ের।

সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় রানার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।

২০১৭ সালের ২৯ অগাস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস এ রায় দেন।

আর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মামলায় রানার মা মর্জিনা বেগমকে ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার সম্পদের ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা বাজেয়াপ্ত করেন বিচারক।

ঢাকার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবির বাবুল জানান, রানার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা ও মাদকের মামলাও বিচারাধীন।

আরও পড়ুন