এই কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৭ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান শঙ্খ ঘোষ, যিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বুধবারই চিরবিদায় নিলেন।
এই কবিতায় কবির ব্যক্তিগত এক অনুভূতি হয়ে উঠলো সমাজের সব সন্তানের জন্য প্রার্থনা।
কবির বড় মেয়ে তখন অসুস্থ। ডাক্তারও ধরতে পারছেন না রোগ। মিলিয়ে যাচ্ছে মুখের লাবণ্য। কবির ভাষায় ‘মন্থর হয়ে যাচ্ছে মনটা’।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে শঙ্খ ঘোষ ভাবছেন, এক সময় যাদের মুখে প্রখর আলো দেখেছেন, তারা কেমন যেন নিষ্প্রভ। সময়টাও সেরকম।
‘কবিতার মুহূর্ত’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, “দু-একটি ছেলেমেয়ে কখনও কখনও পাশ দিয়ে চলে যায়, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়: কদিন আগেও এখানে যত প্রখরতা ঝলসে উঠত নানা সময়ে, তা যেন একটু স্তম্ভিত হয়ে আছে আজ। কেবল এখানেই তা তো নয়, গোটা দেশ জুড়েই।… কিন্তু কেন হল না? আমরাই কি দায়ী নই? কিন্তু কী করেছি আমরা? করতে পেরেছি? আমাদের অল্পবয়স থেকে সমস্তটা সময় স্তূপ হয়ে ঘিরে ধরতে থাকে মাথা। ফিরে আসে মেয়ের মুখ। মনে পড়ে আমার নিষ্ক্রিয়তার কথা।”
মেয়ের অসুখ মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট তৈরি করে রেখেছে। কবির চোখ গেল পশ্চিম আকাশে। সূর্য আড়াল হবে খানিক বাদে। কবির মনে হল, মাটির ওপর জানু পেতে যদি সূর্যের সামনে প্রার্থনায় বসা যায়, সবার জন্য সেই প্রার্থনা!
সন্তানের অসুখে কাতর বাবরের কথা মনে পড়লো শঙ্খ ঘোষের। নামাজে বসে সৃষ্টিকর্তার কাছে সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে মুঘল সম্রাটের কাতর প্রার্থনা মনে পড়ল তার। কবি দ্রুত চলে গেলেন নিজের ঘরে। কলমে উঠে এল ‘বাবরের প্রার্থনা’
এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত—
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন
কোথায় কুরে খায় গোপন ক্ষয়!
চোখের কোণে এই সমূহ পরাভব
বিষায় ফুসফুস ধমনী শিরা!
জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের আজান গান ;
পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
না কি এ শরীরে পাপের বীজাণুতে
কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের?
আমরাই বর্বর জয়ে উল্লাসে
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে ?
না কি এ প্রসাদের আলোর ঝল্সানি
পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়
এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে
লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের ?
আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে ?
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
যে প্রেসিডেন্সি কলেজে শঙ্খ ঘোষ স্নাতক করেছেন, সেখানকারই আরেক ছাত্র ১০ বছরের ছোট প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এই কবিতা গান হয়ে উঠে এসেছে।
কবিতায় সুর দেওয়া প্রতুলের পুরনো নেশা। সুকুমার রায়, বিষ্ণু দে, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যাক প্রিভের, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, মাও জে দংসহ অনেকের কবিতাতেই সুর দিয়েছেন তিনি।
প্রতুলের ‘ওঠো হে’ (১৯৯৪) অ্যালবামে আরও অনেক গানের সাথে ‘বাবরের প্রার্থনা’ গানটিও ছিল।
শঙ্খ ঘোষের কবিতায় সুর করা প্রসঙ্গে প্রতুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শঙ্খ দা‘র অনেক কবিতা ও ছড়ায় আমি সুর করেছি। বাবরের প্রার্থনা প্রথম সুর। ওর ছোটদের ছড়া, রাজনৈতিক ছড়াতেও সুর করেছি।“
অতীত রোমন্থন করে প্রতুল বলেন, “একদিন আমি বাসে করে যাচ্ছি, এক স্টপেজে শঙ্খদা উঠলেন। আমি সিট ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দিয়ে বললাম, শঙ্খদা আমি বাবরের প্রার্থনায় সুর করছি। উনি যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন, ‘ওতে সুর হয় নাকি?‘
“ক্যাসেটটা বের হওয়ার পর এক অনুষ্ঠানে তিনি গানটি শুনলেন। তাকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করেছিলো, তার কেমন লেগেছে। শঙ্খ দা নাকি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়েছে আমি খানিক্ষণ একা প্রার্থনা করলাম‘।”
শঙ্খ ঘোষের শহর (রাগ করে না রাগুনি) ছড়াটিও সুর করেন প্রতুল।
প্রতুল বলেন, “শঙ্খদার সঙ্গে তো আজকের আলাপ নয়। গুজরাট গণহত্যার সময় আমরা একসাথে কাজ করেছি। ওঁর বাড়িতে প্রচুর মিটিং হয়েছে। রাজনৈতিক অনেক কাজে আমরা একসাথে কাজ করেছি। ওঁর একটা বড় গুণ ছিল, গুণীর কদর করতেন।”