ঘরবন্দি সময়ে বৈশাখের কড়া নাড়া

মহামারীকালে ভয় আর সরকারি বিধিনিষেধের মধ্যে বাঙালির দুয়ারে আবার আসছে বাংলা নতুন বছর। আরেকটি বর্ষবরণের প্রস্তুতিতে মন রঙিন হলেও বাস্তবতা একেবারেই অন্যরকম।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিকাজী নাফিয়া রহমান ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2021, 03:00 PM
Updated : 13 April 2021, 03:00 PM

মন খারাপ করা এ সময়ে তাই ঘরে থেকেই বৈশাখ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজধানীবাসী। নাচ আর গানে প্রথম সূর্যোদয় কিংবা নববর্ষের প্রথম দিনে মেলা এবং এখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছেটা এবারও শিকেয় তুলে রাখতে হচ্ছে।

বুধবার, ১৪২৮ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন থেকেই দেশ যাচ্ছে ‘কঠোর’ লকডাউনে। ফলে বাধ্যতামূলক ঘরবন্দি জীবনে এবার ঘরোয়াভাবে উদযাপন করতে হচ্ছে বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ।

দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে যাওয়ায় এবার জনসমাগম এড়িয়ে ভার্চুয়ালি নববর্ষ উদযাপনের নির্দেশনা রয়েছে সরকারের।

ফলে গত বছরের মত এবারও নববর্ষে রাজধানীতে কোনো আয়োজন থাকছে না। মঙ্গল শোভাযাত্রাও হচ্ছে না। থাকছে না বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানও।

পরপর দু’বছর বাসার বাইরের আয়োজন বন্ধ থাকায় অনেকের কাছে বিশেষ করে ছোটদের কাছে বৈশাখী উৎসব যেন ফিকে হয়ে পড়েছে।

তবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে এবার ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন প্রচার করা হবে।

নগরবাসী বলছেন, মহামারীর ধাক্কায় বাধ্য হয়ে বৈশাখের আনন্দ কিছুটা হলেও উপভোগে এবার ঘরে ঘরে নানা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।

একই সঙ্গে বুধবার থেকে রমজান মাস শুরু হওয়ায় এবার খাবারের আয়োজনটা একটু বাড়তি মাত্রা পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফেব্রুয়ারিতে কমে আসায় এবার বৈশাখ উদযাপনের পরিকল্পনা করছিলেন আবুল খায়ের গ্রুপের ডিজিটাল মিডিয়া প্ল্যানার চিন্ময় মজুমদার।

মেয়ের সঙ্গে প্রথম বর্ষবরণকে স্মরণীয় করে রাখতে নিয়েছিলেন বাড়তি প্রস্তুতিও। কিন্তু নিরাশ করছে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ।

গতবারের মতো এবছরও বাংলা নববর্ষের সকালে সুনসান থাকবে রমনা বটমূল। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান এবারও হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে। ফাইল ছবি

“গত বছরও ঘরোয়াভাবে উদযাপন করতে হয়েছে। এবার মেয়ের কারণে বৈশাখ নিয়ে কৌতূহলটা বেশি ছিল। চেয়েছিলাম ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো। সে পরিস্থিতি তো আর নেই।

তবে পরিস্থিতি বদলে গেলেও বাসাতেই নিজের ‘রাজকন্যা’কে নিয়ে বছরের প্রথম দিনটিকে রাঙিয়ে তুলতে চান চিন্ময় মজুমদার।

“মেয়ের জন্য আগে থেকেই নতুন জামা, ব্যান্ড, জুতা কিনেছি। এটা ওর প্রথম বৈশাখ, সেজন্য কিছু আয়োজন করছি। যেহেতু বছরের প্রথম দিন, তাই দিনটার শুরু আমরা শুদ্ধতার সাথে করতে চাই।”

মহামারী ছায়া ফেলেছে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সুদেষ্ণা ঘোষের বৈশাখ উদযাপনেও। রাজধানীর নিকুঞ্জ-২ এর এই বাসিন্দাকেও এবার রঙহীন বর্ষবরণের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।

শিক্ষাজীবনে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরেফিরে কাটিয়েছেন দিনটি। এখন পরিবারের সঙ্গে বৈশাখ উদযাপনের অনুষঙ্গের মধ্যে থাকে নতুন জামা আর ভালো রান্না।

এবার চেনা ছন্দে ছেদ পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এবছর পরিস্থিতিটা একদমই আলাদা। বের হওয়ার উপায় নেই। হয়তবা রান্না-বান্না করে স্বামীসহ দুজনে খাওয়া-দাওয়া, বাসায় ছবি তোলা এটুকু হবে। পরিবার থেকে অনেক দূরে, খারাপই লাগছে। বৈশাখের চিরচেনা রঙটা যেন এখন আর নেই।”

রঙের আচড়ে বৈশাখের আয়োজনকে যারা বর্ণময় করে তোলেন, তাদেরই একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী হাসান আলি। গতবছরের মত এবারও তাকে হতাশ করেছে পরিবর্তিত বাস্তবতা।

তিনি বলেন, “আমরা দুই সপ্তাহ সময় নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করতাম। পহেলা বৈশাখের চেয়েও আগের ১৫-২০ দিন আমাদের কাছে ছিল বড় উৎসব।

“সবাই একসাথে কাজ করা, খাওয়া-দাওয়া। এবার তো এসব কিছুই হচ্ছে না। তবে যদি মঙ্গল শোভাযাত্রা করার সুযোগও আমরা পেয়ে যেতাম, তা আমাদের জন্য বিলাসিতা হয়ে যেত। কারণ বহু মানুষ তো কষ্টে আছে।”

মগবাজারের বাসিন্দা শিলা রহমান প্রতিবছরই নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ পালন করতেন। কিন্তু গত বছর থেকে করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছুই ফিঁকে লাগছে তার। তারপরও সন্তানদের কারণে বাসায় খাবার-দাবারের কিছু আয়োজন করবেন তিনি।

“আসলে পহেলা বৈশাখ আমার কাছে অনেক বড় উৎসব। ঈদের পরে এই দিনটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি নিতাম। বাবার বাসায় সব ভাই-বোনরা একত্রিত হতাম। দিনটা আমাদের জন্য ছিল মিলনমেলা।

“ফেব্রুয়ারি মাসে যখন করোনাভাইরাস কমে আসছিল, তখন ভাবছিলাম এবার নববর্ষ উদযাপন করব। নতুন কাপড় পরে সবাই মিলে ঘুরতে বের হব, সবাই আবার একসঙ্গে হব। হই-হুল্লোড় করব। কিন্তু এখন পরিস্থিতি তো আরও খারাপের দিকে গেল।”

মহামারীর মধ্যে ঘরোয়া আয়োজনেরও পক্ষে নন মধ্য বাড্ডার গৃহিণী নাসরিন পারভীন। বৈশাখী আয়োজনের টাকা লকডাউনের জন্য যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

“পহেলা বৈশাখে আগে শপিং করতাম, পান্তা ইলিশ খেতাম, রমনার বটমূলেও যেতাম। এবারও সবই করা যেত পরিস্থিতিটা যদি পক্ষে থাকত। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে, খবর দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে উৎসব করার পক্ষে নই আমি। গেট টুগেদার, কাউকে দাওয়াত করা- এসব করব না কোনোভাবেই। কেনাকাটাও করিনি।”

একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক খালেদ হাসান প্রতি পহেলা বৈশাখে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে যেতেন। আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় মিষ্টি পাঠাতেন। কিন্তু গত বছর থেকে তা আর হচ্ছে না।

লকডাউনের কারণে বাসায় থাকলেও সেভাবে আর দিনটি উদযাপন করা হবে না তার। তিনি বলেন, “বাসায় ভালো রান্না-বান্নার হয়ত হবে। কিন্তু এ নিয়ে বাড়তি প্রস্তুতি নেই। এখন বাসায় থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা জরুরি। বেঁচে থাকলে অনেক নববর্ষ উদযাপন করা যাবে।”

বর্ণিল এমন মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার থাকছে না মহামারীর কালে।

সাত বছর বয়সী মিরপুর কান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী আরশিয়া আয়াত ২০১৮ ও ২০১৯ সালের বর্ষবরণ করেছে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে। স্কুল বন্ধ থাকায় গত বছর থেকে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে সে।

“আগে সকালে উঠে নতুন জামা পরে বোন ও আম্মুকে নিয়ে স্কুলে যেতাম। বন্ধু আর টিচারদের সাথে মিলে পহেলা বৈশাখে অনেক মজা করতাম। শাড়ি, চুড়ি, মালা, মাথায় ফুল পরতাম।

“স্কুলের মেলা থেকে অনেক কিছু কিনতাম। এখন আর পহেলা বৈশাখে বাইরে যেতেই পারি না। গতবারও ঘরে ছিলাম নতুন জামা পরে। এবারও বাসায় থাকব। ফোন করে বন্ধুদের সাথে কথা বলব। ওদেরকে খুব মিস করি।”

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আফসানা ইসলামও এবারের পহেলা বৈশাখে তেমন কোনো আয়োজন করছেন না। সন্তানদের কাছে দেশীয় ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে নতুন কিছু না কিনলেও আগের লাল-সাদা পোশাকেই ওদের সাজাতে চান।

“জামা পরিয়ে টিভিতে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানগুলো দেখাব। গুড়, মুড়ি, চিড়া, বাতাসা, নাড়ু- এগুলো এনে রেখেছি। কিছু পিঠা বানাবো। বিভিন্ন রকমের ভর্তা, ভাত, ইলিশ ও অন্যান্য মাছ- রান্না করব। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাবো, আমাদের ছেলেবেলার বৈশাখের দিনগুলো ওদের জানাবো।”

তিনি বলেন, “আসলে নিজেদের সংস্কৃতিটা বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি। তাই বাসায় থেকেই ওদের এসব শেখাব।”

অন্য অনেকের মতো এবার পহেলা বৈশাখে তেমন কোনো আয়োজন করবেন না পল্লবীর সত্তরোর্ধ্ব ফরিদা পারভীন।

“প্রতিদিন কত দুঃসংবাদ আসছে। এ পরিস্থিতিতে আসলে নববর্ষ পালনের মতো অবস্থা নেই। এবার পহেলা বৈশাখে আবার প্রথম রোজা। তো খাবারের আয়োজনও করতে পারব না দিনের বেলা। ভর্তা-ভাজি, মাছ দিয়েই রাতের আয়োজন করব।”

মিরপুরের ফুচকা বিক্রেতা মোখলেসুর রহমান জানান, বৈশাখের চেয়ে এবার পরিবার চালানোর চিন্তাই ভাবাচ্ছে তাকে বেশি।

তিনি বলেন, “বৈশাখে তো মেলা হইতো। বিক্রি ভাল হইতো। বাচ্চাদের টুকটাক কাপড়, খেলনা কিনে দিতাম। এবার লকডাউনে কিভাবে চলুম, সেইটা নিয়াই চিন্তায় আছি। বৈশাখের কথা মাথায় নাই।”