দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায় কেবল দুই শর্তে: হাই কোর্ট

দুদকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জরির চিঠি নিয়ে এক মামলায় রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, জনস্বার্থে এবং সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে না হলে নাগরিকের চলাফেরার অধিকার নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করা ‘অসাংবিধানিক’।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2021, 03:02 PM
Updated : 4 April 2021, 03:02 PM

সরকারের বিরুদ্ধে আতাউর রহমান নামের এক ব্যক্তির করা মামলায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চের দেওয়া রায়ে এ অভিমত উঠে এসেছে।

মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৩ অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়েছে, “আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৬ এ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার ১৩ অনুচ্ছেদের প্রতিফলন ঘটেছে। ব্যক্তির চলাফেরার স্বাধীনতা যা তার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। তাতে হস্তক্ষেপ করা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।

“কোনো নাগরিকের চলাফেরা তথা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করতে হলে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সুনির্দিষ্ট কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই জানাতে হবে, যাতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তার বক্তব্য প্রদানের সুযোগ পান।”

সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনায় রায়ে আদালত বলেছে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’ শব্দসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য।

“উপরোক্ত বিধান অনুসারে কোনো নাগরিকের চলাফেরার স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করতে হলে তা হতে হবে প্রথমতঃ জনস্বার্থে এবং দ্বিতীয়তঃ সুনির্দিষ্ট আইন দিয়ে।

“এ ধরনের গৃহীত পদক্ষেপ শুধুমাত্র জনস্বার্থে হলেই চলবে না- তা হতে হবে সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে; আবার শুধু আইনের দ্বারা হলেও চলবে না- হতে হবে জনস্বার্থে।”

হাই কোর্ট বলেছে, “কোনো ব্যক্তির চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করতে হলে উপরোক্ত দুটি শর্তই পূরণ করা অপরিহার্য; দুই শর্তের একটি পূরণ হলে অপরটি না হলে তা আইন সঙ্গত হবে না।”

গত বছর ২৪ অগাস্ট সম্পদের তথ্য চেয়ে নরসিংদীর আতাউর রহমানকে নোটিস দেয় দুদক। তিনি তথ্য দাখিল করার পর ২২ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়।

এই অনুসন্ধান চলাকালে গত বছর ২০ ডিসেম্বর আতাউর রহমান যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে জন্য ইমিগ্রেশন পুলিশকে চিঠি দেয় দুদক।

এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ব্যবসায়ী আতাউর রহমান চলতি বছর রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট দুদকের নোটিসের বৈধতা প্রশ্নে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রুল জারি করে।

সে রুলটি যথাযথ ঘোষণা করে গত ১৬ মার্চ রায় দেয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ।

রায়ে আদালত অভিমত দেয় যে, দুর্নীতি মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিশেষ জজ আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে।

সে রায়টিই রোববার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

এদিকে এ রায়টি স্থগিত চেয়ে দুদক চেম্বার আদালতে আবেদন করে। কিন্তু গত ২২ মার্চ চেম্বার আদালত রায়ে হস্তক্ষেপ না করে দুদকের আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়। সোমবার শুনানির তারিখ রয়েছে।

নিয়মিত মামলা হওয়ার আগে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেশত্যাগে কোনো কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে কিনা সে বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা ও কমিশনের আইনজীবী সুনির্দিষ্ট কোনো আইন বা বিধি আদালতে ‘উপস্থাপন করতে পারেননি’ বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

রায়ে আদালত বলেছে, “সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আদালতের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অভিমত এই যে, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে যে কোনো অপরাধের সাথে জড়িত সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বারিত করার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রণয়ন করা; এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের আইন বা বিধি প্রণয়ন করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের নিকট এ ধরনের বারিত আদেশ প্রার্থনা করা এবং আদলতের অনুমতি গ্রহণ করা।

তবে এ সংক্রান্ত আইন-বিধি না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বতী ব্যবস্থা হিসেবে উচ্চ আদালত থেকে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে রায়ে, যেখানে ১৯৯৭ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ‘যৌন হয়রানী’ সংক্রান্ত একটি মামলার রায়ের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। 

ভারতের সে রায় বিবেচনায় নিয়েই কোনো আইন না থাকার পরও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানী প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানী’র সংজ্ঞা নির্ধারণ ও কয়েকটি নীতিমালা, নির্দেশনা হাই কোর্ট দিয়েছে।

রায়ে বলা হয়েছে, “উপরোক্ত নজীরসমূহের আলোকে আমাদের দ্বিধাহীন এবং নিঃসংকোচ অভিমত এই যে, যথাযথ আইন বা বিধি প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত অত্র রায়ের নির্দেশনা ও অভিমতের আলোকে অভিযোগের অনুসন্ধান কিংবা মামলার তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা/কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেশত্যাগের বিষয়ে যথাযথ আদেশ প্রদানে সম্পূর্ণ এখতিয়ারবান হবে।

“অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রতিনিধির মাধ্যমে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে আবেদন জানালে আদালত সন্তুষ্টি সাপেক্ষে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য, যার মেয়াদ ৬০ দিনের অধিক হবে না, বারিত আদেশ কিংবা স্বীয় বিবেচনায় ন্যায়সঙ্গত অন্য কোনো আদেশ প্রদান করতে পারবে।

“সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ ওই আদেশ বাতিল বা প্রত্যাহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন জানাতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ এবং কাগজাদি, যদি দাখিল করা হয়, পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করতে পারবে। বারিত আদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা/কর্তৃপক্ষ পুনরায় সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করতে পারবে এবং আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ যদি কাগজাদি দাখিল করে তা বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ আদেশ প্রদান করবে।”

‘এইচ এম এরশাদ বনাম রাষ্ট্র’ মামলার রায়ে বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায়ের অভিমত, ‘সরকার বনাম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও অন্যান্য’ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণ, রাষ্ট্র বনাম এম এম রহমতুল্লাহ মামলায় আপিল বিভাগের অভিমতও তুলে ধরা হয়েছে হাই কোর্টের এ রায়ে।

এছাড়া হাই কোর্টের ‘মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বনাম সরকার’ ও ‘আরিফ হোসেন বনাম সরকার’ মামলায় রায়ে অভিমত তুলে রায়ে বলা হয়েছে, ‘উপরোক্ত মামলাসমূহে প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক ও আইনি ব্যাখ্যা-নীতি হতে এটা সুস্পষ্ট যে, “সরকার কিংবা রাষ্ট্রের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা শুধুমাত্র ‘সৌখিন’ বা ‘খেয়ালি ইচ্ছার’ বশবর্তী হয়ে দেশের কোনো নাগরিকের চলাফেরার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে বা নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না।”

রায়ে আরও বলা হয়, “আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, নাগরিকের চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের খেয়াল খুশি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করা অসাংবিধানিক।”