কেমন হবে এবারের ‘লকডাউন’

দ্রুত বাড়তে থাকা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সামাল দিতে এক সপ্তাহের ‘লকডাউনের’ খবর এলেও তার ধরন কেমন হবে তা স্পষ্ট হয়নি এখনও।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2021, 12:13 PM
Updated : 3 April 2021, 04:30 PM

এবার কী কী খোলা থাকবে, কতটা কড়াকড়ি হবে- সেসব প্রশ্ন ঘুরছে সব মহলে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শনিবার সকালে বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সোমবার থেকে এক সপ্তাহের ‘লকডাউন’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

পরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এক ভিডিও বার্তায় লকডাউন পরিকল্পনা নিয়ে সামান্য আভাস দেন।

তিনি বলেন, “লকডাউন চলাকালে শুধু জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আর শিল্প কলকারখানা খোলা থাকবে, যাতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন শিফটে কাজ করতে পারে।"

এই লকডাউন গতবছরের ‘সাধারণ ছুটির মত হবে, নাকি মিরপুরের টোলারবাগ বা অন্য এলাকায় যেভাবে সব কিছু বন্ধ ছিল এবং চলাচল নিয়ন্ত্রিত ছিল- তেমন হবে তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

লকডাউনের বিস্তারিত প্রজ্ঞাপন এখনও না এলেও সোমবার থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল এবং ট্রেন ও নৌযানে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে জানানো হয়েছে।

গতবছর এপ্রিলে সারা দেশে সাধারণ ছুটির মধ্যে চট্টগ্রামের বিপণি বিতান

লকডাউন কেমন হতে পারে- সেই প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে মানুষ মনে করে ছুটি হয়েছে, ঘুরতে চলে যায়। এ কারণে এবার লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সবাইকে ঘরে থাকতে হবে।”

দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গতবছর ২৩ মার্চ প্রথমবার সাধারণ ছুটির ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। শুরুতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি দেওয়ার পর মেয়াদ বাড়ানো হয় কয়েক দফা।

ওই সময় সব অফিস আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছুটির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকার সেই পরিস্থিতি ‘লকডাউন’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

এর আগে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিতের পর গত বছরের মার্চের শুরুতে রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগ এলাকা প্রথম ‘লকডাউন’ করা হয়েছিল।

সাধারণ ছুটির পরেও এলাকাভিত্তিক লকডাউনের অংশ হিসেবে দুই থেকে তিন সপ্তাহ অবরুদ্ধ রাখা হয়েছিল ঢাকার রাজাবাজার ও ওয়ারীসহ কয়েকটি এলাকা।  

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সংক্রমণ বাড়তে থাকায় জাতীয় কমিটির পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আংশিক লকডাউনের পাশাপাশি পুরো লকডাউনের সুপারিশও ছিল।

সংক্রমণ পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে গেলে লকডাউন দেওয়ার চিন্তা সরকারের আগেই ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমে ১৮ দফা যে প্রস্তাব করা হয়েছিল তা অনেক ভেবেচিন্তে, অনেকের পরামর্শ নিয়ে করা হয়েছে। সরকার শুরুতে সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি। এখন আস্তে আস্তে কঠোর হচ্ছে।”

কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অতিরিক্ত ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় লকডাউনের ব্যাপারে তারাও সুপারিশ করেছিলেন। তবে তা দেশজুড়ে করার প্রস্তাব ছিল না। 

“স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৮ দফা প্রস্তাবের একটা ছিল কিছু এলাকায় আংশিক লকডাউন। আমরা বলেছিলাম- হয় আংশিক, নয় মোডিফাইড লকডাউন।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যদি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে ওই ব্যক্তির পুরো বাড়ি বা ফ্ল্যাটকে দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউন করে ফেলা। এই সময় বাইরের সঙ্গে মেলামেশা পুরো বন্ধ রাখতে হবে। তাদের দৈনিক প্রয়োজন বাইরে থেকে মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটাকে তারা মোডিফায়েড লকডাউন বলছেন।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লকডাউনের যে ঘোষণা এসেছে, সেটি ‘টার্গেটেড’ না ‘ব্ল্যাংকেট’ তা এখনও স্পষ্ট নয়।

“যেখানে অনেক মানুষের ভিড় হয়, সেখানে সংক্রমণ বেশি ছড়ায়। সেখানে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা এবং কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধির আওতায় নিয়ে আসা হলো টার্গেটেড পদ্ধতি।

“আর সারাদেশে যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ঘরে রাখা হলো ব্ল্যাংকেট অ্যাপ্রোচ। শেষ উপায় হিসেবে সরকার এ পন্থায় যেতে পারে ।”

গতবছর ভাইরাস দমাতে অবরুদ্ধ ঢাকার রাজাবাজার

কেমব্রিজের পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “নিয়ন্ত্রণ করতে যদি নাই পারি, সেখানে ব্ল্যাংকেট দিতে হবে। কিন্তু এটাই একমাত্র সমাধান না। কারণ এটা এক সময় তুলে নিতে হবে। এ কারণে টার্গেটেড পন্থা অনুসরণ করে তা অনেকদিন ধরে চালাতে হবে।”

ডা. মুশতাক বলেন, এ ধরনের লকডাউন দিলে নিম্ন আয়ের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে।

“…না হলে তারা খাদ্যের জন্য বাইরে বেরিয়ে যাবে। তখন আমরা কেউ নিরাপদ থাকতে পারব না। এটা সফল হবে না, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।”

গত বছরের ৩০ নভেম্বর থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগী কমতে শুরু করে, পাশাপাশি কমে সংক্রমণের হারও। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২৯১ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। 

পরে আবার বাড়তে শুরু করে সংক্রমণ। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাত্রা অনেক বাড়তে থাকে। ২৩ মার্চ তা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ২৯ মার্চ থেকে টানা তিনদিন দৈনিক শনাক্ত ৫ হাজারের বেশি থাকে। ১ এপ্রিল ৬ হাজারের ঘর ছাড়ায়।