বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যেমন জেনেছিল জাপান

বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অকৃত্রিম বন্ধু জাপান। একাত্তরেও মুক্তিযুদ্ধের খবর জানার জন্য আগ্রহে থাকত জাপানিরা। তাদের সেই আগ্রহ মিটত দ্য ইয়োমিউরি শিম্বুন, দ্য মাইনিচি, কিকিজু টু ভিজিয়ালের মতো শীর্ষ পত্রিকাগুলো পড়ে।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2021, 06:06 AM
Updated : 26 March 2021, 06:06 AM

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেমন জেনেছিল জাপানিরা, সেই প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল ৫০ বছর আগের কয়েকটি জাপানি পত্রিকার সংখ্যা। সে সময় পত্রিকাগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব খবর ছাপা হয়েছিল, সবগুলোতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে পরোক্ষ সমর্থন জানানো হয়।

জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক মাইনিচি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সংখ্যায় শিরোনাম করে, ‘পাকিস্তান নাইসেন জোতাই’ (পাকিস্তান গৃহযুদ্ধ)। মূল শিরোনাম ছিল ‘আজুমা গা ডোতুনিমু মেনজেন কা’, বাংলায় যার অর্থ ‘পূর্ব (পাকিস্তান) কি স্বাধীনতা ঘোষণা করল?’

‘সরকারে থাকছে আওয়ামী লীগ’ উপশিরোনামের খবরে যা বলা হয়েছে তার বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়- ‘পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সরকার ভোটে জয়লাভের পরও পশ্চিম পাকিস্তান ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হওয়ার দাবি তুললেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতা মি. (শেখ মুজিবুর) রহমানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়নি। শেখ মুজিবকে এখন কারাভোগ করতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরও জানিয়েছিল। চারদিকে চাপের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ইতিমধ্যে কৌশলে ঢাকায় হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় অনেক নারী শিশুকে হত্যা করা হয়েছে’।

ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছবি দিয়ে এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকায় মি. রহমানের নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী কমপক্ষে ১০০ জন মানুষকে মেরে ফেলেছে’।

১ এপ্রিলের সংখ্যার তৃতীয় পাতার শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে’। সেখানে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যশস্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিবাদে চলা এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা আধুনিক অস্ত্র-সরঞ্জাম দিয়ে হাজার হাজার মানুষ মারছে’।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড হওয়ার কথা এই সংবাদে উঠে আসে। রেলপথ, আকাশপথ বন্ধ থাকা এবং বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কথাও উঠে এসেছে খবরে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়ে এই পত্রিকাটি নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করেছে।

৮ জুনের সংখ্যায় তৃতীয় পাতায় পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ বিধ্বস্ত চেহারা তুলে ধরা হয়েছে। নারী ও শিশুরা অসহায় উল্লেখ করে যুদ্ধে শহর ও গ্রাম ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে বলে তুলে ধরা হয়েছে।

দ্য মাইনিচির ১০ অগাস্ট সংখ্যার প্রথম পাতায় শিরোনাম ছিল, ‘তবে কী রহমানই অস্ত্র?’ এই খবরে বলা হয়- ‘মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দমন করতে পারাকে পাকিস্তান সাফল্য মনে করে। তাকে আটকাতে পারলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে থাকবে বলে পাকিস্তানের গোয়েন্দারা মনে করছে। শেখ মুজিবই হল, এই যুদ্ধের হাতিয়ার। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ভারতের সেনা কমান্ডারের মৌন সম্মতি যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে পারে’।

পাকিস্তান সেনাদের হত্যাযজ্ঞের খবরও জাপানিদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল পত্রিকাটি।

জাপানের আরেক দৈনিক দ্য ইয়োমিউরি শিম্বুনও মুক্তিযুদ্ধের খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ইন্দো গান তাইকো শিনকো’। বাংলায় যার অর্থ ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণ বাড়ছে’।

ওই খবরে বলা হয়েছে- ‘পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সপ্তম রণতরী মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক হামলার প্রেক্ষিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে প্রতিহতের ডাক দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে’।

ব্যাপক বোমা হামলার কথাও সংবাদটিতে উঠে আসে। বাংলাদেশের মানচিত্রের একটি ছবিও এই প্রতিবেদনে জুড়ে দেওয়া হয়।

১৬ ডিসেম্বর পত্রিকাটির দ্বিতীয় পাতায় প্রধান শিরোনাম ছিল ‘গাইকো নো কুরাই কেনেন, নিক্সন হোসো চুশি মো’। যার অর্থ হল ‘কূটনৈতিক ব্যর্থতা, নিক্সনের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর বাতিল’

ওয়াশিংটন থেকে ইয়োমিউরি শিম্বুনের সাংবাদিক ওতানাবের লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তার সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর বাতিল করেছেন। ... ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের তুমুল যুদ্ধের পর সেখানকার ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রকে হতাশ করেছে’।

পূর্ব পাকিস্তানের একটি গ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান নেওয়ার ছবি প্রকাশ করে পাকিস্তানকে চীনের সমর্থন দেওয়া কথাও এ প্রতিবেদনে বলা হয়।

পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ইয়োমিউরি শিম্বুনে ‘ঢাকার মানুষ মুক্ত, পাকিস্তান সেনাদের অস্ত্র আত্মসমর্পণ’ শিরোনামে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি, পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার একটি ছবি দেওয়া হয়।

ঢাকায় ট্রাকে করে মানুষের বিজয়োল্লাসের আরও একটি ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের রুখে দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেল বাংলা। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের আত্মসমর্পণে উল্লাস মিছিল করেছে’।

ওইদিন তৃতীয় পৃষ্ঠায় আরও কয়েকটি ছবি ছাপে পত্রিকাটি।

১৮ ডিসেম্বর পত্রিকাটির খবরে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের জান্তা ইয়াহিয়ার ছবি প্রকাশ করা হয় সংখ্যাটিতে।

১৭ ডিসেম্বর মাইনিচির দ্বিতীয় পাতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদে বলা হয়, ‘দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুক্তি মিলল। স্বাধীন দেশ হিসেবে পূর্ব বাংলায় বিজয় উল্লাস হয়েছে’।