সুবর্ণ প্রভা নিয়ে এল অনন্য এক মার্চ

বাঙালির রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতার সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে; সেই বাংলাদেশ এখন সুবর্ণজয়ন্তীর দুয়ারে, সামনে সোনালি ভবিষ্যতের হাতছানি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2021, 03:44 AM
Updated : 16 March 2021, 05:27 AM

সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও এখন যুঝছে করোনাভাইরাস মহামারীর সঙ্গে। তার মধ্যেই এবারের মার্চ বাঙালির জীবনে এসেছে অনন্য সাধারণ এক উদযাপনের উপলক্ষ নিয়ে।

যার হাত ধরে একাত্তরে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সেই মহান নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপন চলছে গতবছরের মার্চ থেকে। আর এবারের মার্চে তা মিলছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর উদযাপনের সঙ্গে। 

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক শেখ মুজিব। তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মের শত বছর পূর্ণ হয়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার ঠিক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনে কিছুটা ছেদ পড়েছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার মুজিববর্ষের সময়কাল ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। সংক্রমণের মাত্রা কমে এলে বড় পরিসরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আশা করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জন্মশতবার্ষিকী বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের একটি সমন্বয় সভাও হয়েছে।

রমনা রোসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। ৭ মার্চ, ১৯৭১। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

কামাল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মার্চ মাস এল। আমাদের পুরো কর্মসূচি নিয়ে গণমাধ্যমে জানাব কয়েকদিন পরেই। আমাদের কিছু কাজ এখনও বাকি রয়েছে। ১০ দিনের প্রোগ্রাম করছি- এটুকু জেনে রাখেন।”

কেন্দ্রীয়ভাবে ১৭ থেকে ২৬ মার্চ এ আয়োজন হবে। এর বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে নানা আয়োজনও থাকবে।

উদযাপনের দশ দিন

১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন থেকে স্বাধীনতা দিবস- এই দশ দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা চলছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ ও স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ অন্তত বড় দুটি অনুষ্ঠান হতে পারে। এর বাইরে স্থানীয় প্রশাসনের নানা অনুষ্ঠানেরও পরিকল্পনা রয়েছে।

কামাল চৌধুরী বলেন, “মুজিববর্ষ বাস্তবায়ন কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। ১০ দিনের যে প্রোগ্রাম সাজানো হচ্ছে, ২৬ মার্চ পর্যন্ত তা হবে। তারপরে মুজিববর্ষ সারাবছরই চলবে। মার্চের প্রথম থেকেই অনেকে অনেক প্রোগ্রাম হবে; ৭ মার্চও প্রোগ্রাম থাকবে। মেইন প্রোগ্রামটা দশ দিনের; যেটা জাতীয় কমিটি করবে।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আয়োজনে অংশ নিতে ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকায় আসার কথা রয়েছে।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, মোদীর সফরের দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে ২৬ শে মার্চ সকালে কিংবা দুপুরে যদি আসেন, সেক্ষেত্রে বিকালে হবে মূল অনুষ্ঠান।  

তাছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিস্থলে যাওয়ার বিষয়টি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব।

গেল বছরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে মুজিববর্ষ উদ্বোধনের মূল অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, তাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীও আমন্ত্রিত ছিলেন।

উৎসবে বাদ সেধেছে মহামারী

সরকার ২০২০-২০২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে। গঠন করা হয় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ এবং ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’।

২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিবসে লোগো উন্মোচনের পাশাপাশি ক্ষণগণনার মাধ্যমে মুজিববর্ষের আয়োজন শুরু হয়।

বাঙালির মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

ওইদিন বিকাল ৫টায় তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আবহও ‘প্রতীকীভাবে’ ফুটিয়ে তোলা হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যে বিমানে করে দেশে ফিরেছিলেন, সেই আদলের একটি বিমানও হাজির করা হয় অনুষ্ঠানে।

এরপর সব পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকে। ১৭ মার্চ বর্ণাঢ্য আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ঘটা করে উদযাপন করা হবে- এমনই ছিল পরিকল্পনা। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে আনুষ্ঠানিক আয়োজন উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সেদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের। পাশাপাশি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।

কিন্তু ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে ওই কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। জনসমাগম এড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণ রাত ৮টায় দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একযোগে সম্প্রচার করা হয়।

সেই আয়োজনের পর জাতির জনকের জন্মদিনের সব অনুষ্ঠান ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়।

এরপর ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মেহেরপুরের মুজিবনগর দিবস উদযাপন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তি দিবস, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন, জাতীয় শোক দিবস, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ প্রদানের দিন, জেল হত্যা দিবস সবই অনলাইনে উদযাপিত হয়।

বঙ্গবন্ধুকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিদেশে বাংলাদেশের ৭৭টি দূতাবাসে ২৬০টিরও বেশি অনুষ্ঠানের আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।