মাধ্যমিকের ‘অ্যাসাইনমেন্ট’: মূল্যায়ন কতটা হল?

মহামারীর মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে যে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল, অধিকাংশ শিক্ষার্থী তা জমা দিলেও কেউ উত্তর লিখেছে ফেইসবুকে পাওয়া লেখা থেকে, কেউ আবার শিক্ষকদের সহায়তা নিয়েছে।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2021, 06:04 PM
Updated : 28 Feb 2021, 06:04 PM

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত অক্টোবরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, মহামারীর কারণে বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়েই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পরের শ্রেণিতে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পরীক্ষা নিতে না পারলেও শিক্ষার্থীদের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে যাতে পরের ক্লাসে তা পূরণের ব্যবস্থা করা যায়, সেজন্য শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৩০ দিনে শেষ করা যায় এমন একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করে তার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের প্রতি সপ্তাহে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের তিনটি করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়া, মূল্যায়ন, পরীক্ষকের মন্তব্যসহ সেটি শিক্ষার্থীকে দেখানো এবং প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের কাজ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে বলা হয় সেখানে।

রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর মা মমতাজ বেগম জানান, লিখতে প্রথমে অসুবিধা হলেও পরে বন্ধু-বান্ধবদের সহায়তা নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করেছে তার মেয়ে।

“স্কুল খোলা থাকলে যেমন পড়াশোনা হত, সেরকম তো হচ্ছে না। স্কুল কবে খুলবে সে অপেক্ষায় থাকলে তো তারা পিছিয়ে যাবে। সে কারণে কেউ বসে নেই। সবাই ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেটে দিচ্ছে।”          

ওই বিজ্ঞপ্তিতে, নোট বা গাইড বই না দেখে এবং অন্যের লেখা নকল না করে পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে উত্তর লেখার নির্দেশনা দিয়েছিল মাউশি।

অন্যের লেখা নকল করে জমা দিলে তা বাতিল করে নতুন করে সেই অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছিল।

বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্ঠম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী জানাল, ডিভাইস সঙ্কট আর নেটওয়ার্কের অসুবিধার কারণে তাদের ক্লাসের অনেকেই নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারেনি। ‘স্যারদের হেল্প নিয়ে’ তারা অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের আজিমপুর শাখায় অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছেন এক অভিভাবক। ফাইল ছবি

ওই ছাত্রীর মা শারমিন সুলতানা বলেন, “অ্যাসাইনমেন্ট করার সময় ওরা অনেক কিছু সঠিক বুঝতে পারেনি। পরের ক্লাসেও একই রোল হবে বলে ভালো করার আগ্রহও তেমন ছিল না ওর মধ্যে। ‘সবাই তো দেখে লিখতেছে, আমি দেখে লিখলে অসুবিধা কী’- ও এরকমও বলেছে।”

অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ সেভাবে হয়নি মন্তব্য করে এই অভিভাবক বলেন, “তারা কতটা বুঝল তা কিন্তু স্যাররা ওভাবে দেখে নাই। অনেক অভিভাবক হয়ত বাসায় শিক্ষক নিয়ে ওই গ্যাপটা দূর করতে চাচ্ছেন, কিন্তু সবাই তা পারছে না। এভাবে পরের ক্লাসে উঠিয়ে দিয়ে বাচ্চারা কতটা লাভবান হল, সেই প্রশ্নটা থাকছে। গ্যাপগুলো খুঁজে বের করে যদি তা পূরণ করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ভাল হয়।”

নরসিংদীর দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানাল, অ্যাসাইনমেন্টে যেসব প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে তার উত্তর লিখতে তার কোনো সমস্যা হয়নি, কারণ ফেইসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে আর ইউটিউবে অনেকেই উত্তর তুলে দিয়েছিল।

“অনলাইন থেকে হেল্প নিয়ে, বাসার অন্যদের থেকে হেল্প নিয়ে প্রশ্নগুলো সলভ করেছি আমরা। সেজন্য তেমন অসুবিধা হয়নি।”

অ্যাসাইনমেন্টের আওতায় শিক্ষার্থীদের ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন, সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর, সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর, প্রতিবেদন প্রণয়নের মত কাজ দেওয়া হয়েছিল ।

মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানালো, প্রশ্নগুলোর উত্তর কোথা থেকে লিখতে হবে সে বিষয়ে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকরাও পরামর্শ দিতেন।

“ম্যাথ, অ্যাকাউন্টিংয়ের অ্যাসাইন্টমেন্ট করার সময় স্যারদের হেল্প নিতাম। বাকিগুলা নিজেরা ফেইসবুক থেকে দেখে লিখতাম। ক্লাসেও স্যাররা বলে দিতেন যে ‘এ প্রশ্নের উত্তর বইয়ের এখান থেকে লিখবা’।”

মাউশির সেই বিজ্ঞপ্তিতে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু অনলাইনে ক্লাস করতে না পারায় অ্যাসাইনমেন্টের তথ্য পায়নি বলে জানালো ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী।

তার মা সুরমা বেগম বললেন, “শুনছি ষষ্ঠ শ্রেণির ওদের নাকি অ্যাসাইনমেন্ট দেয়নি। ওর প্রাইভেটের স্যারের সাথেও কথা বলছি; স্যারও বলছে, ওদের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়নি।”

তবে ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক নাজনীন আক্তার বলেন, “তাদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল। যারা অনলাইন ক্লাস করেছিল তারা দিয়েছে। ৬০ শতাংশের মত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে।”

অনলাইন ক্লাস না হওয়ায় অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে হিমশিম খেতে হয়েছে বলে জানালো শেরপুরের নবদিগন্ত একাডেমির সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী।

“স্কুল খোলা থাকতে যেগুলো পড়ানো হয়েছে, সেগুলো থেকে যে প্রশ্ন আসছে, তার উত্তর লিখতে অসুবিধা হয়নি। বাকিগুলো লিখতে কষ্ট হয়েছে। স্কুল খোলা থাকলে ভালো হত।”

শেরপুর সদরের নবারুণ পাবলিক স্কুলের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বড় বোন উম্মে হাবিবা দৃষ্টি বললেন, স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার সাথে সম্পৃক্ততা অনেকটাই কমে গেছে তার ভাইয়ের।

“ক্লাস করার কথা বলে মোবাইল নিয়ে গেমস খেলে। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলেও পড়াশোনা তেমন করে না।” 

দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষে সরাসরি পাঠদান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকই আবার ‘প্রাইভেটে’ ঝুঁকেছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ বণিক সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর মা শিরিন আখতার বললেন, “সে বাসায় পড়াশোনা করছে, প্রাইভেটেও দিয়েছি। অ্যাসাইনমেন্ট করার সময় সমস্যা হইছিল। পরে ইউটিউব দেখে আর প্রাইভেট টিচারের সাহায্য নিয়ে করে ফেলেছে।”

ঢাকার বনশ্রীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রও ‘প্রাইভেট টিচারের’ সহায়তা নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করার কথা জানাল। 

ঢাকার সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাফর ইকবাল বললেন, ‘বেশিরভাগ’ শিক্ষার্থীই অ্যাসাইনমেন্ট লিখেছে ‘একে অপরেরটা দেখে’।

“ফটোকপির দোকান থেকে বিভিন্ন স্কুলের নোট সাপ্লাই দেওয়া হয়, আসলে ওরা গাইড নির্ভর পড়ালেখা করতে করতে ভাবে যে গাইডের ভিতরেই থাকতে হবে। যারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে, পরামর্শ নিয়েছে, তারা আবার ভালো লিখেছে।”

রাঙামাটির শহীদ আব্দুল আলী একাডেমির প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, অসচ্ছলতা আর প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকার কারণে তার স্কুলের ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারেনি।

“এখানে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী বেশি। পারিবারিক অসেচনতা আর সুযোগ সুবিধা না থাকায় অনেকে অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি। সরাসরি ক্লাস করলে আমরা যতটুকু শিখনফল পাই, ততটুকু পাইনি।”

প্রথম দিককার অ্যাসাইনমেন্টগুলোতে উত্তরের মান ভালো না হলেও অ্যাসাইমেন্টের উপর কিছু ক্লাস নেওয়ার পর ‘মানোন্নয়ন’ হয়েছে বলে জানান এ শিক্ষক।

ফেইসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে আপলোড করা অ্যাসাইনমেন্টের সমাধানের ছবি।

“পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা সব দিক দিয়েই পিছিয়ে। তাদের অভিভাবকরাও পিছিয়ে। তাদের কোথায় কোথায় গ্যাপ রয়েছে তা আমরা নোট করেছি। ক্লাস যখন শুরু হবে, তখন ফাঁকে ফাঁকে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকদের দিয়ে পূরণ করানোর পরিকল্পনা আছে আমাদের।”

চাঁদপুরের মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার বলছেন, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা ‘সচেতন’ থাকায় তার স্কুলের কারো অ্যাসাইনমেন্ট করতে অসুবিধা হয়নি।

“শ্রেণীকক্ষে যখন আমরা ওদের পড়াই, তখন তো আউটপুটটা ভালো থাকে। আমরা ওদের বুঝতে পারি, আবার ওরা সাথে সাথে ওদের সমস্যাগুলো সমাধান করেতে পারে। এখানে (অনলাইন ক্লাস) রেসপন্সটা তুলনামূলক কম হলেও ওরা চেষ্টা করেছে, আমরাও ফোন করে ওদের হেল্প করেছি।”

শিক্ষার্থীদের আগের ক্লাসের ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে- সে বিষয়ে পরিকল্পনা করতে দ্রুতই প্রতিষ্ঠান প্রধান, শিক্ষকদের নিয়ে বসবেন বলে জানান এই শিক্ষক।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন্নাহার বলেন, সীমাবদ্ধতা থাকলেও তাদের সব শিক্ষার্থীই গুরুত্বের সঙ্গে অ্যাসাইমেন্ট শেষ করেছে।

“সামনাসামনি ক্লাস তো একটা আলাদা জিনিস। অনলাইন ক্লাস আর সরাসরি ক্লাসের প্রভাবটাও একরকম হবে না। যখন প্রতিষ্ঠান খুলে যাবে, তখন আর ঘাটতি থাকবে না, পূরণ করে দেওয়া হবে।”

এই মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্জিত শিখনফলের দুর্বলতা চিহ্নিত করে পরবর্তী শ্রেণিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল মাউশির নির্দেশনায়।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মূল্যায়নের কাজ এখনো চলছে।

“স্কুলে স্কুলে ফলাফল আগেই হয়েছে, তারপরও ন্যাশনালি মূল্যায়ন হবে একটা।”

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মাউশির মহাপরিচালক বলেছিলেন, সারা দেশে ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে।