‘পুলিশ অভিযোগ তদন্ত কমিশন’ গঠনের দাবিতে রিট

পুলিশসহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার তদন্ত করতে ‘স্বাধীন পুলিশ অভিযোগ তদন্ত কমিশন’ গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2021, 08:27 AM
Updated : 28 Feb 2021, 08:27 AM

সুপ্রিম কোর্টের ‘শতাধিক’ আইনজীবীর পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির রোববার হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদনটি করেন।

পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার হাই কোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদনটির শুনানি হতে পারে।”

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক, অবসরপ্রাপ্ত সচিব, আইনের শিক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের অন্তর্বর্তী আদেশ চাওয়া হয়েছে ওই রিট আবেদনে।

এই কমিটি করতে হবে এমনভাবে, যাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে তারা সরাসরি আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারে।

শিশির মনির বলেন, ‘স্বাধীন পুলিশ অভিযোগ তদন্ত কমিশন’ গঠন করতে বিবাদীদের গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর উকিল নোটিস পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে রিট আবেদনটি করা হয়।  

আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শককে সেখানে বিবাদী করা হয়েছে। ১৪৫ পৃষ্ঠার রিট আবেদনের সাথে ১ হাজার ৫২২ পৃষ্ঠার নথি (ডকুমেন্ট ) যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

আবেদনে পুলিশ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান, পুলিশের গৌরবময় অর্জনের বর্ণনা তুলে ধরার পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলায় বিদ্যমান আইনি কাঠামো সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এবং কমিশন গঠনের জন্য আটটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে।

সেই সাথে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ ও অসদাচরণের’ ৫৮৯টি অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে বলে আইনজীবী জানান।  

এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- বিচারবহির্ভূত হত্যা; হেফাজতে মৃত্যু; হেফাজতে নির্যাতন;  গুম, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়; খুন, মারধর, হুমকি ও হয়রানি; ধর্ষণ, ইভটিজিং ও নারী নির্যাতন; চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাট; চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য ও ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়; জমি দখল ও সম্পত্তি বিনষ্টকরণ; মাদক ব্যবসা ও উদ্ধারকৃত মাদক আত্মসাৎ; আটক বাণিজ্য; অপরাধীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া; মামলা নিতে গড়িমসি ও মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ; মিথ্যা ও পাল্টা মামলা দিয়ে হয়রানি; তদন্তে গাফিলতি, হয়রানি ও ঘুষ গ্রহণ; সাংবাদিক নির্যাতন; কর্তব্যে অবহেলা, সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্টকরণ ও আসামিদের নাম বাদ দেওয়া, নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে দুর্নীতি।

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “রিটে দৃষ্টান্ত হিসেবে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ছয়টি মামলার অনুলিপি সংযুক্ত করা হয়েছে। এসব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অভিযোগ ওঠা পুলিশ সদস্যদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”

এ আইনজীবী বলেন, “তদন্ত হল বিচারের প্রাথমিক ধাপ। ন্যায়বিচারের জন্য প্রধান শর্ত হল সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত। সুষ্ঠু তদন্ত সংবিধানের ৩৫(৩) ও ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। বর্তমান আইনি কাঠামোতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার তদন্তের দায়িত্ব পুলিশকেই দেওয়া হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

“এ বিষয়ে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘পুলিশ অধ্যাদেশ’ নামে একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছিল। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৭১ দফায় ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট কমিশন’ গঠনের বিধান প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সেই খসড়া অধ্যাদেশ আজও আইনে পরিণত হয়নি।”

এছাড়া রিটে আটটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও নীতিমালা যুক্ত করা হয়েছে। এসব আন্তর্জাতিক দলিলে পুলিশের অপরাধ তদন্তে আলাদা কর্তৃপক্ষ বা কমিশন গঠনের জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ডেনমার্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, কেনিয়া, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, গ্রিস, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ফিনল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, হাঙ্গেরি, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস ও মাল্টা, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন কার্যকর আছে বলে রিট আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০০৬ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ‘প্রকাশ সিং বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ মামলায় পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য যে ৭ দফা নির্দেশনা ছিল, তা এই রিট আবেদনে তুলে ধরা হয়েছে; যার মধ্যে আছে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট অথরিটি’ গঠনের নির্দেশনা। 

রিটে বলা হয়েছে ওই নির্দেশনায় ইতোমধ্যে ভারতের ২৭টি অঙ্গরাজ্যে ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট অথরিটি’ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের স্বাধীন কমিশন বা কর্তৃপক্ষ গঠনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

রিট আবেদনকারী আইনজীবীদের মধ্যে মো. আসাদ উদ্দিন, রেদোয়ান আহমেদ, মো. সাইফুল ইসলাম, শিকদার মাহমুদুর রাজি, শ্যাম সুন্দর দাস, ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ সাজ্জাদুল ইসলাম, মো. মোর্শেদ মীর, জামিলুর রহমান খান, শেখ নাসের ওয়াহেদ (সিমন), মো. আল-আমিন, আল রেজা মো. আমির, ইমরুল কায়েস, গোলাম সারোয়ার, মো. শাহাবুদ্দিন খান (লার্জ), মো. দুলাল মিয়া, মো. জাকির হায়দার, মো. আব্দুল আলীম, মো. হুমায়ুন কবির, জি এম মুজাহিদুর রহমান, মো. মতিয়ার রহমান অন্যতম।