আহমদ শরীফের মতো শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষের অভাব: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সমাজ বদলের প্রশ্নে অধ্যাপক আহমদ শরীফের মতো শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষের এখন বড় অভাব বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2021, 06:51 PM
Updated : 24 Feb 2021, 08:19 PM

তিনি বলেছেন, “আমরা আজকে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াতে পারি না। সব মেনে নেই, আমরা না বলতে পারি না। কিন্তু আহমদ শরীফ ছিলেন দৃঢ় মেরুদণ্ডের। সমাজ পরিবর্তনে ড. আহমদ শরীফের মতো শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষ আজ বড় অভাব।”

বুধবার বিকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে গবেষক ও প্রাবন্ধিক ড. আহমদ শরীফের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত স্মারক বক্তৃতা ও স্মারক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, “আমরা অনেক পণ্ডিত দেখেছি, লেখকও অনেক দেখেছি। কিন্তু পাণ্ডিত্য ও সাহিত্য চর্চার বাইরে সমাজ মনস্কতা, সমাজ পরিবর্তনের আগ্রহ- এই সমন্বয়টা খুবই দুষ্প্রাপ্য। সেটি আহমদ শরীফের মধ্যে ছিল। তার পরাজিত হওয়ার মনোভাব ছিল না। আমরা আমাদের রাজনীতিতে দেখি, সেখানে একটা পরাজিতের মনোভাব আছে। আমাদের বামপন্থি, সমাজতন্ত্রীদের মধ্যেও দেখি আমরা আপস করে ফেলি এই ভয়ে যে, আমরা বেশি দূর যেতে পারব না। আহমদ শরীফ একাকী অনেক দূর যাওয়ার পথে ছিলেন।”

সমাজ পরিবর্তন নিয়ে আহমদ শরীফের চিন্তাধারা বর্ণনা করতে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই সমাজের অসুখটা কোথায়। তার লেখায় আমরা সেই চিন্তার পরিচয় পাই। তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর জন্য সমাজতন্ত্রই সর্বোৎকৃষ্ট’। আজকে থাকলে তিনি এই কথা বলতেন, সমাজতন্ত্র কেবল পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর জন্য নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্য তা দরকার।

“আজকে সমাজতন্ত্র ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই। এই যে করোনাভাইরাস, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা পুঁজিবাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ। পুঁজিবাদ মানুষকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন করে, মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে, এই করোনাভাইরাস সেটিই করেছে। মানুষের সকল অর্জন ও সভ্যতার অগ্রগতিকে নাকচ করে দিয়ে এই রোগ বলেছে, তুমি স্বার্থপর হও, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অসামাজিক হও। এই মহামারী পুঁজিবাদের চরম ফল।”

ড. আহমদ শরীফের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে স্মারক পুরস্কার দেওয়া হয়। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ‘আহমদ শরীফ চেয়ার অধ্যাপক’ আবুল কাসেম ফজলুল হক তার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন। এ সময় ডা. জাফরুল্লাহর জীবনী পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মো. আযম।

পুরস্কারের তাৎপর্য তুলে ধরে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আমরা আজকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে স্মারক পুরস্কার দিলাম। তিনিও আহমদ শরীফেরই যেন উত্তরাধিকারী। তিনিও ওই ধারাতেই আছেন, যে কাজ আহমদ শরীফ করতে চেয়েছেন, সেটা হচ্ছে সমাজে পরিবর্তন আনা। আজকে জাফরুল্লাহ দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। আহমদ শরীফের যেমন মেরুদণ্ড শক্ত ছিল, আমাদের জাফরুল্লাহ চৌধুরীরও সেই রকম মেরুদণ্ড। এটা আরও তাৎপর্যপূর্ণ এই যে, জাফরুল্লাহর সমস্ত কর্মকাণ্ড ব্যক্তি মালিকানার জন্য নয়, তিনি সামাজিক মালিকানার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমরা সমাজে এই আদর্শই প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তাই আমরা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আজকে পুরস্কৃত করে আহমদ শরীফের ধারাকে আমরা স্বীকৃতি দিলাম।”

পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অধ্যাপক আহমদ শরীফের সঙ্গে তার স্মৃতিচারণ করে বলেন, “এই পুরস্কার আমাকে আমার দায়িত্ববোধকে যতটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, তা অন্য কোনো পুরস্কার পারেনি। আহমদ শরীফ সব সময় মানুষের কথা ভাবতেন। তিনি আজ বেঁচে থাকলে আমাদের বলতেন, ‘ছাত্ররা আন্দোলন করছে, আপনারা এখনও ঘুমিয়ে আছেন কেন? যান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যান। আজ শিক্ষার্থীদের উপর গণপরিবহনের শ্রমিকেরা হামলা করে, গ্রামবাসীরা হামলা করে। তিনি বেঁচে থাকলে প্রয়োজনে একাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন।”

ড. আহমদ শরীফের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন না করায় আক্ষেপ করে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “আজকে ড. আহমদ শরীফের জন্মশতবর্ষের এই অনুষ্ঠানটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করার কথা। কিন্তু তারা তাকে স্মরণ করছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এজন্যই জাগতে পারছে না। তারা বিক্রি হয়ে গেছে। তারা ’৭৩ এর অধ্যাদেশের মর্মার্থ বোঝে না।”

অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, “প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা, অস্বীকার করার ক্ষমতা, না বলার ক্ষমতা, সত্যকে উচ্চারণ করার ক্ষমতা হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের শক্তির জায়গা। এই শক্তি তার মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। সেই শক্তি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং পরবর্তীতে আরও অনুপ্রাণিত করবে যদি তার কাজ তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা যায়। এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মাঝে সমাজের মধ্যে প্রশ্ন তোলা, বিচার-বিবেচনা ছাড়া কোনো কিছু গ্রহণ না করা, পর্যালোচনা ছাড়া বিশ্বাসের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে না দেওয়া এবং বিচার-বিবেচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে কোনো কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষমতা তৈরি হবে।”

করোনাভাইরাসের কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানের স্মারক বক্তা কলকাতার জনপ্রিয় লেখক ড. প্রথমা রায়মণ্ডল।

তিনি তার স্মারক বক্তৃতা ‘আহমদ শরীফের মননশীল সাহিত্যে চিন্তার দর্শন’ ভিডিও আকারে পাঠান।

সেখানে তিনি বলেন, “আহমদ শরীফের অ্যাকাডেমিক সাহিত্য, চিন্তাত্মক গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং গবেষণা-অভিসন্দর্ভে তার মনন ও চিন্তার প্রকাশ এবং এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তার চিন্তার শৃঙ্খলা। তার মননশীল প্রবন্ধে তত্ত্বমূলক ও সমালোচনামূলক সাহিত্য চিন্তার সন্ধান মেলে। তার কোনো প্রবন্ধের কোথাও অহেতুক বর্ণনার গুরুভার নেই, কিংবা নেই স্তূপীকৃত তথ্যের আধিক্য ।”

অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি ড. আহমদ শরীফের জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক বদরুদ্দীন উমর। তার পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ডা. ফয়জুল হাকিম।

তিনি বলেন, “১৯৭২ সালের পর ধান্ধাবাজ লেখকদের যে বিস্তার ঘটেছিল, অধ্যাপক আহমদ শরীফ তার বাইরে এসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। তিনি কোনো কিছুকেই ভয় না পেয়ে তার নির্ভীক লেখনি চালিয়ে গেছেন আজীবন।”

বাবার স্মৃতিচারণ করে ড. আহমদ শরীফের ছেলে অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, “তিনি সব সময় আমাদের কুসংস্কারমুক্ত রেখেছেন। আমরা যেভাবে যা হতে চেয়েছি, তিনি তা হতে দিয়েছেন। তবে তিনি সব সময় আমাদের সত্যের পথে চলতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।”

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে হেমঙ্গ বিশ্বসের গান ‘আরো বসন্ত/বহু বসন্ত’ পরিবেশন করেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এছাড়া করোনাকালে প্রয়াত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে আহমদ শরীফ স্মরণে স্বরচিত কবিতা ‘সমীপে আহমদ শরীফ জন্মশতবর্ষে’ পাঠ করেন উদযাপন কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কবি হাসান ফকরী। আহমদ শরীফের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন।