আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নতুন মাথাব্যথা ‘আইস’

ইয়াবা সামলাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিমশিম খাওয়ার মধ্যে দেশে মাদকের তালিকায় যোগ হয়েছে ‘আইস’; যা আরও বেশি ক্ষতিকর বলে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদককামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Feb 2021, 06:33 PM
Updated : 3 Feb 2021, 06:33 PM

প্রায় দুই বছর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিয়মিত অভিযানে ৫ গ্রাম আইসসহ এক যুবককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তখনই আইসের কথা জানা যায়।

এরপর ওই যুবকের স্বীকারোক্তিতে জিগাতলার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হাসিব বিন মোয়ামের রশিদ নামে এক ব্যক্তিকে।

রশিদ ওই বাসার তলকুঠুরীতে ‘আইস’ তৈরির কারখানা বসিয়ে সবে উৎপাদন শুরু করেছিল বলে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খুরশীদ আলম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রশিদের কাছে ২৯ গ্রাম 'আইস' পাওয়া গিয়েছিল।

পরে রশিদের স্বীকারোক্তিতে বসুন্ধরা এলাকায় থেকে নাইজেরীয় এক নাগরিককে ৫০০ গ্রাম 'আইস' সহ গ্রেপ্তার করা হয়।

“ওই কারখানার সন্ধান না পাওয়া গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হত,” বলেন খুরশীদ।

দুই মাদকের তুলনা করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, “ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে পাঁচ ভাগ, আর আইসের পুরোটাই এমফিটামিন। ফলে এটি ইয়াবার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ক্ষতিকর এবং অনেক বেশি পরিমাণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে মানবদেহে।”

অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানবদেহে অতি অল্প সময়ে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এই মাদক।

“এই মাদক সেবনে মস্তিষ্কের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই মাদক সেবনের ফলে স্মৃতি শক্তি লোপ পায়।”

আইস বা ক্রিস্টাল মেথে শতভাগ এমফিটামিন থাকায় এটা বিশ্বজুড়েই ভয়ঙ্কর মাদক হিসেবে চিহ্নিত, বলেন তিনি।

গতবছর নভম্বরে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেথামফিটামিন মাদক ‘আইস’ বা ‘ক্রিস্টাল মেথ’সহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মো. মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুই বছর ধরে আইস দেশে আসতে শুরু করেছে।

গত ৪ নভেম্বরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গেণ্ডারিয়া থেকে ছয়জনকে ৬০০ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার করে।

ডিএমপির উপ-কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকায় পুলিশের অভিযানে আইস পাওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম।

এরপর এ বছরের ১৪ জানুয়ারি হাতিরপুল ও হতিরঝিল এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে আইসসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইস থাইল্যান্ডে বেশি ব্যবহার হয়। এই মাদকটিও মিয়ানমার হয়ে আসতে শুরু করেছে। ইয়াবার সঙ্গে আইসও পাওয়া যাচ্ছে।”

বাংলাদেশে শুরুর দিকে মাদক হিসেবে আফিম ও গাঁজাই চলত। গত শতকের ৮০ এর দশকে সেগুলো নিষিদ্ধ করা হয়।

ওই সময়ে কোডিন মিশ্রিত কফ সিরাপ নিষিদ্ধ হওয়ার পর চোরাই পথে আসা ফেনসিডিল হয়ে ওঠে মাদকসেবীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।

প্রায় দুই দশক হল ফেনসিডিলের জায়গা দখল করেছে ইয়াবা। ফেনসিডিল মূলত আসত ভারত থেকে, আর ইয়াবা আসছে মিয়ানমার থেকে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে নানা বৈঠকে ফেনসিডিল পাচার বন্ধে আহ্বান জানানো হয়, যার ফলও পাওয়া যায়।

কিন্তু ইয়াবা পাচার বন্ধে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া না পাওয়ার কথা গত বছরও বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

ইয়াবা সহজে বহনযোগ্য বলে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে।

২০১৯ সালে মূলত ইয়াবা ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়েই মাদকের বিরুদ্ধে বড় অভিযানে নেমেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে কয়েকশ জন।

বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ওই ঘটনায় র‌্যাব-পুলিশকে ব্যাপক সমালোচনায় পড়তে হলেও সেই অভিযানেও ইয়াবা পাচার বন্ধ হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবা ধরার খবর আসছে।

এরমধ্যে আইসের ব্যবহার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা উদ্বিগ্ন- জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি খুবই ব্যয়বহুল মাদক। এজন্য ইয়াবার মতো ছড়ানোর আশঙ্কা কম। তবে পুলিশ সতর্ক আছে, যাতে এই মাদকটির বিস্তার ঘটতে না পারে।”

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আইস মালয়েশিয়া হয়েও আসে। সেখানে ১ গ্রাম আইসের দাম ১৫ হাজার রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন লাখ টাকার বেশি।

উপকমিশনার আজিম বলেন, “স্রোতের সঙ্গে সবকিছুই আসবে। আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।”