সাড়ে তিন বছর পর যখন চীনের মধ্যস্থতায় আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আশা দেখছিল বাংলাদেশ, তখনই মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হল।
Published : 01 Feb 2021, 08:23 PM
তবে মিয়ানমারে ক্ষমতার পরিবর্তনে রোহিঙ্গা প্রশ্নে দেশটির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকরা।
তারা বলছেন, ক্ষমতা হারানো অং সান সু চির আড়ালে থেকেই সেনাবাহিনী এতদিন সব করছিল, এখন তারা সামনে এল, পার্থক্য কেবল এটা।
তবে দেশটির সেনা সরকারকে আন্তর্জাতিক মহল কীভাবে দেখছে, সেদিকে এখন নজর রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন এই বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “আমাদের চুক্তিটা তো অং সান সু চির সাথে না, তার দলের সাথেও না। আমাদের সাথে চুক্তি ছিল মিয়ানমার রাষ্ট্রের সাথে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক।
“সে জায়গায় প্রত্যাবাসনের জন্য যে চুক্তি হয়েছে, আমরা চাইব যেভাবে ঠিক করা হয়েছে, সেভাবে সময় মতো শুরু হবে।”
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”এ যাবত অং সান সু চির সরকার আমাদের সঙ্গে যে আলোচনা করছিল, আমি বিশ্বাস করি যে, তারা সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্সটা নিয়েই করছিল। সেনাবাহিনী যা চায়, সেটাই তারা করছিল।
“কাজে সেনাবাহিনী যেহেতু সামনাসামনি চলে আসছে, এটাতে বড় কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আমি দেখি না। পজিটিভ বিরাট কিছু হয়ে যাবে, তার সম্ভাবনা আছে বলেও আমি মনে করি না। নেগেটিভ তো আছে, আর কিছু নেগেটিভ হওয়ার মতো নাই।”
দীর্ঘদিনের তিন লাখের সঙ্গে গত তিন বছর ধরে আরও আট লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে এসেছে তারা।
এদের ফেরত নিতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার তিন বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। সর্বশেষ গত ১৯ জানুয়ারি মিয়ানমারের সঙ্গে চীনে মধ্যস্থতায় ভার্চুয়াল বৈঠকে বসে বাংলাদেশ।
ওই বৈঠকের পর বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুম বিন মোমেন।
তবে মিয়ানমারে পটপরিবর্তনের কারণে এই বৈঠক হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ।
তিনি বলেন, “তারা সময়ক্ষেপণ করবে, পরিস্থিতির কারণে ফেব্রুয়ারিতে যে মিটিংটা হওয়ার কথা, তা হয়ত হবে না। হয়ত স্থগিত হবে। আবার এমনও হতে পারে, হবে। যে কোনোটাই হতে পারে।”
সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে একটি রোডম্যাপ তৈরিতে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
“বলে দিলেই তো যাবে না। ওপারে যদি তাদের কিছু অধিকারের নিশ্চয়তা না পায়, মৌলিক মানবাধিকার যেটা, সেটা নিশ্চিত না হলে তো তারা (রোহিঙ্গা) রাজি হবে না। রাজি না হলে আমরা দুই-চার হাজার পাঠাই বা দুই লাখ পাঠাই, সেটাতে লাভ হবে না।”
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “আগেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে সত্তরের দশকে, নব্বইয়ের দশকে দুইবার প্রত্যাবাসন হয়েছে। তখন তো গণতন্ত্র ছিল না কোনো ধরনের।
“আর গত তিন বছরে যে গণতন্ত্র ছিল, সেটা দিয়ে তো কোনো লাভ হয় নাই, প্রত্যাবাসনও শুরু হয়নি। সে জায়গায় আমাদের চিন্তার কারণই নেই।”
এই অবস্থায় মিয়ানমার কেমন চাপে পড়ে, তা দেখার পক্ষপাতি অধ্যাপক ইমতিয়াজ। আর সে দেশের ভেতরও কেমন প্রতিক্রিয়া হয়, তাও দেখতে চান তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করবে, তার উপর সব কিছুর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“তারা বড় আকারের অবরোধ দেবে কি না, বড় আকারের চাপ দিবে কি না মিয়ানমারের উপরে। তারা যদি বলে যে, অপেক্ষা করবে এক বছর, আগের মতোই যদি করে, তাহলে বোঝা যাবে, এখানে (ক্যু) হয়ত তাদেরও এক ধরনের সমর্থন ছিল।”
সেনাবাহিনী এক বছরের জন্য মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারি করেছে, এই সময়টাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
“যদি বড় আকারে প্রেসার আসে, তাহলে আবার এক ধরনের গণতন্ত্রের মতো করবে, আবার নির্বাচনের মতো করে কিছু একটা করবে।”
সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক কমিউনিটি কী করে, আমাদের দেখা দরকার এখন। আন্তর্জাতিক মহল এতদিন বলত গণতন্ত্রকে রাখতে হবে ইত্যাদি। এখন বোঝাই গেল তাদের ভুল পদক্ষেপ ছিল।”
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “আমরা তো বরাবরই বলে এসেছিলাম, এটা টেকসই গণতন্ত্র না তাদের, সামরিক বাহিনী এমনিতে বলতে গেলে ক্ষমতায় ছিল। যদিও একটা আবরণ তৈরি করেছিল, অং সান সু চিকে নিয়ে। এখন সেই আবরণ সরে গেল।”
মিয়ানমারে ক্ষমতা পরিবর্তনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা মিয়ানমারের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি।”
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার কঠোর নিন্দা করেছে। অন্যদিকে চীন একটু ঘুরিয়ে বলেছে, তারা মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা দেখতে চায়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে মিয়ানমারে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার পাশাপাশি শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।
সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও অব্যাহত থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেছে।