বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আহ্বানে বৃহস্পতিবার একযোগে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী এই কর্মসূচি পালিত হয়।
আগামী ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তিন শিক্ষকের চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী সমাবেশ হয়। একই সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও একই কর্মসূচি পালিত হয়।
গত বছরের শুরুর দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন-ফি কমানো, আবাসন সংকট নিরসনসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগ এনে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল ফজলকে বরখাস্ত এবং একই বিভাগের প্রভাষক শাকিলা আলম ও ইতিহাসের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরীকে অপসারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া আন্দোলনের সময় শিক্ষকদের সঙ্গে ‘অসদাচরণ’ এবং একাডেমিক কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও বাংলা বিভাগের ছাত্র ইমামুল ইসলাম সোহান ও মোবারক হোসেন নোমানকেও বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
টিএসসির সমাবেশে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে তিন দফা দাবি জানানো হয়- শুধু দুই শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আশ্বাস নয়, তিন শিক্ষকের বহিষ্কারাদেশও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে হবে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটকে অবৈধ ঘোষণা এবং এই সিন্ডিকেট যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা তদন্ত করতে হবে, উপাচার্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার লংঘন করে যে ‘অপরাধ করেছেন’, তা তদন্ত করতে হবে।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, এর জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে আমার বলতে ইচ্ছে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মমার্থ, সেটি বুঝতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ভলতেয়ারের একটি উক্তি আছে, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবনও দিতে পারি।’ এটিই হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দিয়ে জ্ঞানচর্চা তৈরি হয় এবং এটি দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, “খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি রাজনীতি চলবে না। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কি একটি কারাগার? আমার জানতে ইচ্ছে করে এ বিশ্ববিদ্যালয় কি একটি ক্যান্টনমেন্ট? উপাচার্য সামরিক বাহিনীর জেনারেল নাকি যে মানুষ কথা বলতে পারবে না, আন্দোলন করতে পারবে না? এই ব্যর্থ উপাচার্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসনে থাকা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা খুলনায় যাব, উপাচার্য ভবন ঘেরাও করব।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খান বলেন, “আমাদের রাষ্ট্রের যারা শাসক আছেন তারা বক্তৃতায় বলেন, আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে ঢুকে গেছি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য তারা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি করবেন। কিন্তু তারা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি করবেন কীভাবে, একটা সমাজ জ্ঞানভিত্তিক হতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সৃজনশীলতা। আর সৃজনশীলতার প্রথম শর্ত হচ্ছে প্রশ্ন, আপনি প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ রাখছেন না, প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে যে সৃজনশীলতার চর্চা হয়, তা আপনারা রোধ করছেন। আপনি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন করছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শাসক আছে, তারা নিজেদেরকে আমলা মনে করছে। যারা রাষ্ট্রের শাসক তারা আমলাকে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারি চাকরিবিধি দিয়ে।
“এ রকম আমলাতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা যখন তৈরি হচ্ছে তখন আসলে সৃজনশীলতা, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এসব ভণ্ডামি, মকারি ছাড়া আসলে অন্য কোনো কিছুই নয়। সেই রকমই একটা রূপ আমরা দেখতে পেলাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আচরণের মধ্য দিয়ে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আচরণ অশিক্ষকসুলভ ও ক্রিমিনাল মাইন্ডের পরিচায়ক।”
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, “খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ যদি প্রত্যাহার না হয় তাহলে আমরা শিগগিরই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করব এবং দাবিগুলো না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান রাহাদ, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক অমল ক্লান্তি, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি আরিফ মহিউদ্দিন সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন।
জাহাঙ্গীরনগরে মানববন্ধন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচিতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ছিলেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা অস্বাভাবিক মনে হলেও এর আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চায় পুলিশ, আমলা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার শ্রেণির লোকদেরকে প্রশাসনে বসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি রোবটে পরিণত করতে। তারা চায় না কেউ মুক্ত চিন্তা করুক, সৃজনশীল চিন্তা করুক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মত মেরুদণ্ড থাকুক। তারা চায় এমন শিক্ষক যারা শিক্ষা চর্চার সঙ্গে থাকবে না, বরং প্রশাসনের অনুগত হবে।”
আগামী ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শাস্তিমূলক সিদ্দান্ত প্রত্যাহার না হলে নতুন করে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে এ কর্মসূচিতে ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার, অধ্যাপক মানস চৌধুরী, অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান সুমন, অধ্যাপক এমদাদুল হুদা, অধ্যাপক আবদুল জব্বার হাওলাদার, অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান, অধ্যাপক জামাল উদ্দিন, সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ ও সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক কর্মসূচিতে ছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন মিছিল-মানববন্ধন
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নেওয়া ‘প্রতিহিংসামূলক’ শাস্তি প্রত্যাহারের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন, মৌন মিছিল ও সমাবেশ করেছেন ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক চত্বরে ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক’ ব্যানারে প্রতিবাদী সমাবেশ হয়।
সমাবেশে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি আ-আল মামুন বলেন, “উপাচার্য ফায়েক উজ্জামান তার ব্যক্তিগত জিঘাংসা চরিতার্থ করতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি যখন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তখন আর মাত্র দুই দিন আছে তার উপাচার্য পদ। যেন উনি চলে গেলেও এই প্রক্রিয়াটা ঝুলে থাকে এবং উনাকে আর দায় না নিতে হয়। আর এটা এমন এক সময়ে করলেন যখন করোনাভাইরাসের জন্য সব বন্ধ। তার ব্যক্তিগত জিঘাংসা এমন স্তরে পৌঁছে গেছে যে, আমি বলব এটা এক ধরনের অসুস্থতা।”
এই অধ্যাপক বলেন, “খুলনায় অবৈধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেই অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ার পেছনে যারা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। যেই সিন্ডিকেট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এই পরিমাণ হয়রানি করতে পারে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের টাকায় চলে। আমরা চাই সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক।”
এর আগে বেলা ১১টায় একই দাবিতে শিক্ষার্থীরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে ও হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল ও প্যারিস রোডে মানববন্ধন করেন।
কর্মসূচিতে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নাসির হোসেনের সঞ্চালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসেন, মহব্বত হোসেন ও হাসিব রনি বক্তব্য দেন। এ সময় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।