দুদকের সবার সম্পদের হিসাবও দেওয়া হোক: বিচারক

দুর্নীতির অনুসন্ধানে অন্য সবার সম্পদের হিসাব যে সংস্থা চায়, নানা ঘটনায় সমালোচনা ওঠায় এখন সেই দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তাদের সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশের কথা বলেছে উচ্চ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Jan 2021, 01:27 PM
Updated : 28 Jan 2021, 01:43 PM

দুদকের ভুল তদন্তের কারণে ১৫ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া নিরাপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল সংক্রান্ত রুল শুনানিতে বৃহস্পতিবার এই কথা আসে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের কাছ থেকে।

শুনানির এক পর্যায়ে এই বিচারপতি বলেন, “কমিশন অনেক ভালো কাজ করছে। কিন্তু দু-একটি ঘটনা সারাদেশে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়। আমরা তো চাই কমিশন সবাইকে নোটিস দিক। সবারই সম্পত্তির হিসাব দেওয়া উচিৎ।”

এতে দুদকের গ্রহণযোগ্যতাই বাড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যদি কমিশনের কমিশনাররাসহ সমস্ত কর্মকর্তা কর্মচারী জনসমক্ষে হিসাব বিবরণী প্রচার করে কাজ করেন, তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে আরও বেশি বেশি বাড়বে।”

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের এই হাই কোর্ট বেঞ্চ রায়ে নিরাপরাধ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল করেছে।

সেই সঙ্গে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। মামলাটিতে ভুল ব্যক্তিকে যুক্ত করার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে।

আর ভুল তদন্তের শিকার কামরুল ইসলাম যদি ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুদকে আবেদন করেন, তবে দুদককে তা বিবেচনা করতে বলেছে হাই কোর্ট।

আদালতে কামরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী। আর দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।

এর আগে নরসিংদীর পাটকল শ্রমিক নিরাপরাধ জাহালমের কারাবাসের ঘটনায় সমালোচনায় পড়েছিল দুদক।

সুপ্রিম কোর্ট

‘এটা হয় অপেশাদারিত্ব, নয় তো অসততা’

এ রায়ের আগে আইনজীবী মিনহাজুল হক শুনানিতে বলেন, ঠিকানা পরিবর্তন হওয়াতে আসামি বদলে গেছে। এখন যাকে আসামি করে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ খুঁজছে, ঘটনার সময় তার বয়স ছিল আট বছর। মূল আসামির জন্ম ১৯৭৭ সালে। আর রিট আবেদনকারীর (কামরুল ইসলাম) জন্ম সাল ১৯৯০ সালে।  

তিনি বলেন, দুদকের আইনে প্রথমেই অভিযোগের বিষয়ে একটি অনুসন্ধানের বিধান আছে। অন্যান্য অপরাধের মতো এ আইনে সরাসরি এফআইআর হয় না। এখানে এফআইআর  হয় অনুসন্ধানের পরে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, প্রশংসাপত্র জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। সেখানে আসামির নাম, পিতার নাম, ঠিকানা পরিপূর্ণভাবে দেওয়া আছে।

“তারপরও ধরে নিলাম, প্রথম এফআইআরে ভুল হয়েছে। তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম ভুল হতেই পারে। কিন্তু সেটিও সংশোধনের সুযোগ আছে। উনারা (তদন্তকারী কর্মকর্তারা) ১০ বছর তদন্ত করলেন। এফআইআর করা হয় ২০০৩ সালে। পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করা হয় ২০১৩ সালে। প্রায় ১১ বছর। দুদক আইনের বিধিতে বলা আছে, তদন্তকারী আসামির খোঁজ করবেন, তার সাক্ষ্য নিবেন। তদন্তকারী মনে করলে তার শুনানি করবেন। প্রতি মাসে তার প্রতিবেদন কমিশনের দাখিল করবেন। তারপর কমিশন চার্জশিট অনুমোদন করবেন।”

এই আইনজীবী বলেন, “দুদক যে বলছে, ‘সরল বিশ্বাসে ভুল করেছে’, এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। এত বছর তদন্ত করে তিনি (তদন্তকারী কর্মকর্তা) গ্রামের নামের আগে পূর্ব না পাশ্চিম সে বিষয়ে কিছুই জানতে পারলেন না! আসলে তদন্তকারী কিছুই করেননি। এটা অপেশাদারী কাজকর্ম। আর যদি জেনে করেন, তাহলে অসততা।”

দুর্নীতি দমন কমিশন

‘কমিশন লজ্জিত’

রিট আবেদনকারীর আইনজীবীর বক্তব্যে জবাবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম শুনানিতে বলেন, “এই মামলাটি হল দুর্নীতি দমন ব্যুরোর। এই তদন্তকারী ১০ বছর তদন্ত করেছে, এটা ঠিক না। উনি (দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মাহফুজ ইকবাল) ছিলেন শেষ তদন্ত কর্মকর্তা। আর এটাই উনার প্রথম তদন্ত।”

তখন বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম জানতে চান, তদন্ত কর্মকর্তা কবে এই মামলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। 

জবাবে এর তারিখ বলতে না পারলেও দুদকের আইনজীবী বলেন, “বিশেষ জজ যদি অভিযোগপত্র যাচাই-বাছাই করতেন তাহলে এটা হত না।”

বিচারক কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে তখন বলেন, “অভিযোগপত্রে তদন্তকারী যে ঠিকানা দিয়েছেন, মামলার প্রসিডিংস তো সে অনুযায়ীই হয়েছে। হয় এখানে আপনাদের (প্রসিকিউশনের) দোষ, নয় তদন্তকারীর দোষ। এখানে পাবলিক প্রসিকিউটরের দোষও রয়েছে, তারও দায় নিতে হবে। এটা তার (তদন্তকারী দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মাহফুজ ইকবাল) প্রথম তদন্ত। এ কারণে এটা তার ভালো করা উচিৎ ছিল।”

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “বিভিন্ন মিডিয়ায় এই মামলা সম্পর্কে রিপোর্ট হয়েছে। এরকম দুই-একটা ভুলের কারণে গোটা প্রতিষ্ঠান কিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়? কিছু কিছু লোক আছে, কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে বা যাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা থাকে, তারা ফেরেশতার মত থাকবেন।

“আসামির ঠিকানা ঠিক আছে কি না, তা দেখার জন্য একজন তদন্তকারী আছেন, তদারকীর জন্যও আরেকজন থাকেন। তিনি কী পরামর্শ দিলেন?”

দুদক আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বিচারপতি বলেন, “ভুল ব্যক্তিকে দোষি করেছেন। আপনি (দুদক) যখন স্বীকার করছে ভুল আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে (তদন্তকারী ও তদারকী কর্মকর্তা) বিভাগীয় ব্যবস্থার কথা জানান। এ বিষয়ে দুদক কী ব্যাখ্যা চেয়েছে?”

তখন দুদক আইনজীবী জানান, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

বিচারক তখন বলেন, এটি একটি আমলাতান্ত্রিক শব্দ।

দুদক আইনজীবী এরপর বলেন, “এ ঘটনায় পুরো কমিশন লজ্জিত।”

কামরুল ইসলাম

নির্দোষ কামরুল যা বললেন

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় কামরুল ইসলাম বলেন, “অনেকটা টেনশনমুক্ত লাগতেছে। আমি রিলিফ পাইছি আরকি। বিনা কারণে একটা মামলায় আমি দোষী হইলাম, এখন মাননীয় হাই কোর্ট রায়ের মাধ্যমে আমাকে একটা রিলিজ দিল। রায়ে আমি সন্তুষ্ট।”

নোয়াখালীর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন এই কামরুল।

তিনি বলেন, “আমার মতো অন্য কেউ যাতে এ ধরনের হয়রানির শিকার না হয়। এ বিষয়ে সবাই সতর্ক থাকবেন। যারা মামলা করবেন, মামলার তদন্ত করবেন, তারা যেন মামলার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে নেন ঠিকমত। সুষ্ঠুভাবে মামলার তদন্ত হলে কেউ হয়রানির শিকার হবেন না।”

এটা কি দুদকের তদন্ত কর্মকর্তার ‘সরল বিশ্বাসে’ ভুল বলেই মনে করছেন- সাংবাদিকদের প্রশ্নে কামরুল বলেন, “মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। এটা অনেকটা সেরকমই মনে হয়। যে কর্মকর্তা মামলার এজাহারটি দায়ের করেছেন, তিনিই ভুলটা করে গেছেন। ওই এজাহারেই পশ্চিমের জায়গায় পূর্ব লিখে যেতে পারেন। হতে পারে এইটা অনিচ্ছাকৃত ভুল।”

২০০৩ সালের সালের জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কুমিল্লা অঞ্চলের প্রসিকিউটিং পরিদর্শক মো. শহীদুল আলম এসএসসির সনদ জালিয়াতির অভিযোগে নোয়াখালী সদর থানার পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের আবুল খায়েরের ছেলে কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

ব্যুরো বিলুপ্তির পর কমিশনের অধীনে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর মামলাটিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

বিচার শেষে নোয়াখালীর বিশেষ জজ শিরীন কবিতা আখতার ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর রায় দেন। রায়ে আসামি কামরুলকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

রায়ের পর আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশি তৎপর হলে নোয়াখালী সদরের পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের কামরুল বিচারিক আদালতের দণ্ড চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।

তাতে বেরিয়ে আসে, নাম ও বাবার নামে মিল হলেও আসামি কামরুলের গ্রাম পশ্চিম রাজারামপুরে। দুদকের ভুলে আসামি হয়েছেন পশ্চিম রাজারামপুর গ্রামের কামরুল।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কখনোই দেখা বা কথা হয়নি বলেও জানান কামরুল।

“কখনোই তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে আমার দেখা বা কথা হয়নি। আমার সাথে কেউ কখনও যোগাযোগ করেনি। করলে তো তখনই ধরা পড়ত (ভুলটি)।”

এ ঘটনায় ক্ষতির শিকার হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি এবং আমার পরিবার সমাজে হেয়-প্রতিপন্ন হয়েছি। আমি ছোটোখাটো একটা চাকরি করি। আমার বাবাও চাকরি করতেন। সমাজে তার একটা জায়গা ছিল,এ মামলার কারণে তাকেও হেয়প্রতিপন্ন হইতে হইছে।

“রায়ের কথা পুরা এলাকায় জানাজানি হয়। তখন অনেক ভয়ে ছিলাম, কখন পুলিশ আইসা ধইরা নিয়া যায়। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। মানসিকভাবেও আমি আমার ফ্যামিলি অনেক প্রেশারে ছিলাম।”

ক্ষতিপূরণ চাইবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, রায় হাতে পেলে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবেন।

বর্তমানে ৩১ বছর বয়সী কামরুল ইসলাম দুই সন্তানের জনক। তার বড় ছেলের বয়স ৫ বছর আর ছোটো ছেলেটি ১ বছরের।