দুদকের ‘ভুলের’ শিকার কামরুলের সাজা বাতিল

দুদকের ভুল তদন্তের কারণে ১৫ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া নিরাপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল করে দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Jan 2021, 08:46 AM
Updated : 28 Jan 2021, 08:46 AM

সেই সঙ্গে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। এছাড়া মামলাটিতে ভুল ব্যক্তিকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আর কামরুল ইসলাম যদি ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুদকে আবেদন করেন, তবে দুদককে তা বিবেচনা করতে বলেছে হাই কোর্ট।

এ মামলার দণ্ড চ্যালেঞ্জ করে নিরাপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের রিটে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ রায় দেয়।

কামরুল ইসলাম

আদালতে মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী। আর দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।

আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী পরে সাংবাদিকদের বলেন, “মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের ভুল সাজার বিরুদ্ধে করা রিট আবেদনটি আজকে আদেশের জন্য ছিল। মাননীয় আদালত উভয়পক্ষের শুনানি শেষে জারি করা রুলটি যথাযথ ঘোষণা করেছেন।

“রুল যথাযথ ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে, এই আসামিকে সাজা পরোয়ানা মূলে গ্রেপ্তার করা যাবে না এবং কোনোভাবে হয়রানি করা যাবে না।”

এ আইনজীবী বলেন, “বিশেষ জজ যে রায়টি দিয়েছিলেন সে রায়টি বাতিল করা হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে। এছাড়া মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালত যে সাজা পরোয়ানা জারি করেছিল, সে সাজা পরোয়ানাটি হাই কোর্ট রিকল করেছে এবং মামলাটি পুনঃতদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে।”

ওই তদন্ত দুদকও করতে পারে, আবার দুদকের এখতিয়ারের বাইরের ধারা থাকলে অন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলোও তা করতে পারে বলে জানান মিনহাজ। 

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “তদন্তকারী কর্মকর্তা ‘সরল বিশ্বাসে’ ভুল করেছেন। তাদের বিষয়ে আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। কমিশন এ রায়টি পাওয়ার পরে খতিয়ে দেখবে। যদি তদন্তকারী কর্মকর্তার ইচ্ছাকৃত ভুল পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই তার বা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিভাগীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

১৯৯৮ সালের এসএসসির সনদ জালিয়াতি করে কলেজে ভর্তি হওয়ার অভিযোগে ২০০৩ সালে এক যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো।

তার ১০ বছর পর ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয় বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। পরের বছরই মামলার রায় হয়।

রায়ে আসামিকে পলাতক দেখিয়ে দণ্ডবিধির তিনটি ধারায় ৫ বছর করে ১৫ বছরের সাজা দেয় বিচারিক আদালত। সেই সঙ্গে ১০ হাজার টাকা করে মোট ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

ওই রায়ের পর পুলিশি তৎপরতা টের পেয়ে মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বিচারিক আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।

হাই কোর্ট তার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করে। সে রুলের জবাবে দুদক বলে, এটা তদন্তকারী কর্মকর্তার ‘সরল বিশ্বাসের ভুল’।

গত সোমবার সেই রুলের উপর শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার রায় দেয়।

মামলা বৃত্তান্ত

২০০৩ সালের জানুয়ারিতে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কুমিল্লা অঞ্চলের প্রসিকিউটিং পরিদর্শক মো. শহীদুল আলম একটি এজাহার দায়ের করেন।

সেখানে বলা হয়, নোয়াখালী সদর থানার পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের আবুল খায়েরের ছেলে কামরুল ইসলাম নোয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৫৭৬ নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাসের জাল/ভুয়া মার্কশিট ও প্রশংসাপত্র সৃজন/সংগ্রহ করে ১৯৮৯-৯৯ সেশনে মাইজদী পাবলিক কলেজে ভর্তি হন।

মামলাটির তদন্ত করেন দুর্নীতি দমন কমিশন নোয়াখালীর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মাহফুজ ইকবাল। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর মামলাটির অভিযোগপত্র দেয় দুদক।

বিচার শেষে নোয়াখালীর বিশেষ জজ শিরীন কবিতা আখতার ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর রায় দেন।

রায়ে কামরুল ইসলামকে দণ্ডবিধির ৪৬৭, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারায় ৫ বছর করে মোট ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে মোট ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন বিচারক।

রায়ে বলা হয়, ‘সকল কারাদণ্ড একত্রে চলিবে’ অর্থাৎ আসামিকে জেল খাটতে হবে ৫ বছর। কিন্তু তিনটি ধারায় পাওয়া অর্থদণ্ড আলাদাভাবে অর্থাৎ ১০ হাজার টাকা করে মোট ৩০ হাজার টাকাই দিতে হবে। এই অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় রায়ে।

রায়ের পর আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশি তৎপর হলে নোয়াখালী সদরের পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের মো. আবুল খায়েরের ছেলে মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বিচারিক আদালতের দণ্ড চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।

সেই আবেদনে বলা হয়, তিনি ১৯৯০ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে হরিনারায়ণপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। দারিদ্রের কারণে কলেজে তিনি ভর্তি হতে পারেননি।

২০০৮ সালের ৮ জুলাই এমএলএসএস হিসেবে লক্ষ্মীপুর আদালতে যোগ দেন তিনি। পরে নোয়াখালীতে বদলি হন। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে তিনি নোয়াখালী আদালতের সহকারী হিসেবে কর্মরত।

রিট আবেদনে বলা হয়, মামলায় (জালিয়াতির মামলা) ১৯৯৮ সালের ঘটনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তখন তার বয়স ছিল আট বছর। আর যে কামরুল ইসলামের কথা মামলার রায়ে বলা হয়েছে, সে কামরুল ইসলামের বাড়িও একই উপজেলায়। কাকতলীয়ভাবে তার বাবার নামও এক। তবে গ্রামের নামের আদ্যাংশে পার্থক্য রয়েছে।

রিট আবেদনকারী মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের গ্রাম পূর্ব রাজারামপুরে। আর আসামি কামরুল ইসলামের গ্রাম পশ্চিম রাজারামপুরে। সুতরাং রিট আবেদনকারী মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম আসামি নন, দণ্ডিতও নন।  

রিট আবেদনে পূর্ব রাজারামপুরের মোহাম্মদ কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি না করতে নির্দেশনা চাওয়া হয়।

ওই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট গত বছর ৫ নভেম্বর রুল জারির পাশাপাশি দুদকের কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা চায়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রুলের জবাব দিয়ে দুদক ভুল স্বীকার করে।