ছিটমহলের দুঃখ ঘুচেছে, এবার মিলছে ঘর

বাংলাদেশের মধ্যে বাস করেও এদেশের ঠিকানা ছিল না কুড়িগ্রামের দশিয়ারছড়ার বাসিন্দাদের, পাঁচ বছর আগে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ে সেই দুঃখের অবসান হওয়ার পর এখন প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে পাকা ঘর পাচ্ছেন সেখানকার হতদরিদ্ররা।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব কুড়িগ্রাম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2021, 03:44 PM
Updated : 22 Jan 2021, 04:41 PM

সারা জীবনের চেষ্টায়ও যে মাথা গোজার ঠাঁই করতে পারেননি, অনায়াসে স্বপ্নের সেই বসত ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন তারা।

মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার দাশিয়ারছড়ার যে কয়টি পরিবার জমিসহ পাকা ঘর পাচ্ছে, তাদের একজন আলিফ উদ্দিন।

জমির সঙ্গে নতুন ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান আলিফ উদ্দিন, তাদের মতো দশিয়ারছড়ার পাঁচটি পরিবারকে জমি ও নতুন ঘর দেওয়া হচ্ছে।

ষাটোর্ধ্ব এই কৃষি শ্রমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে আমরা নিজেদের পরিচয় পেয়েছিলাম। এই সরকারের সময়েই আবার নিজের বাড়িও পেলাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আজীবন ঋণী হয়ে গেলাম। তার দীর্ঘ হায়াত কামনা করি।”

কুড়িগ্রাম সীমান্ত থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে ফুলবাড়ী উপজেলার দাশিয়ারছড়া আয়তনের দিক দিয়ে পাঁচ বছর আগেও ছিল সবচেয়ে বড় ছিটমহলগুলোর একটি।

১ হাজার ৬৪৩ একর আয়তনের দাশিয়ারছড়ার মালিকানা ছিল ভারতের হাতে। বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে থেকেও প্রায় ৯ হাজার বাসিন্দার জাতীয়তা ছিল ভারতীয়।

দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, দাশিয়ারছড়াসহ ভারতের ১১১টি ছিটমহল ২০১৫ সালের ১ অগাস্ট প্রথম প্রহর থেকে হয়ে যায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অংশ। একইভাবে ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়।

আলিফ উদ্দিন বলেন, “নিজের একটা ঘরের অভাব ছিল। সেই অভাবটাও এখন দূর হল।”

ওই সময় বাংলাদেশে থেকে যাওয়া দাশিয়ারছড়ার আরেক বাসিন্দা আবদুস সালামও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সা“মান্য কৃষি কাজ করে কোনো রকম সংসার চালাই। ইচ্ছা থাকলেও নিজের বাড়ি করতে না পারার একটা আক্ষেপ সব সময় ছিল।”

এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ঘর পেয়ে সেই আক্ষেপের অবসান হচ্ছে তার।

এক সময়ের ছিটমহল দশিয়ারছড়ার পাঁচটি পরিবার এই এলাকায় নিজেদের ঘর পেতে যাচ্ছেন।

তাদের মতো মুজিববর্ষে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার’ হিসেবে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় জমির সঙ্গে ঘর পেতে চলেছেন ভূমিহীন-গৃহহীন অর্ধ লাখের বেশি পরিবার।

এই প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী সরকারের আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হচ্ছে।

“আগামী শনিবার বিশ্বে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমির মালিকানা দিয়ে বিনা পয়সায় দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘর মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী প্রদান করবেন।”

এছাড়া ২১টি জেলার ৩৬টি উপজেলার ৪৪টি গ্রামে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণের মাধ্যমে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

দেশজুড়ে বাস্তবায়নাধীন এই কর্মসূচির আওতায় কুড়িগ্রাম জেলার নয়টি উপজেলায় ১ হাজার ৫৪৯টি বাড়ি করে দেওয়া হবে বলে জানান কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম।

এসব ঘরের মধ্যে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ২০০, ফুলবাড়ি উপজেলায় ১৬৫, নাগেশ্বরী উপজেলায় ২৬৪ এবং রাজারহাট উপজেলায় ৭০টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার ঘর পেতে যাচ্ছে।

শুক্রবার সেখানে গেলে নতুন পাকা ঘর পেতে যাওয়া ভূমিহীনরা এতদিনের কষ্টের কথা তুলে ধরেন।

তারা বলছেন, নতুন ঘরের মধ্য দিয়ে তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। এতদিন সমাজে সবার চোখে ‘ছোট’ থাকলেও এখন তাদের আত্মপরিচয় তৈরি হচ্ছে।

নাগেশ্বরী উপজেলার বেড়ুবাড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা মিষ্টি বেগম (২৩) নতুন পাওয়া ঘরের দেওয়ালে আল্পনা করে স্বামী আলামিন ও নিজের নাম বড় করে লিখেছেন।

ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন মিষ্টি বেগম, প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে নতুন ঘর পেয়ে সামনেই স্বামী ও নিজের নাম লিখেছেন তিনি।

মিষ্টি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নয় বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। আল আমিন সিরাজগঞ্জে তাঁতের কাজ করে সংসার চালায়। কিন্তু সংসারে অভাব থাকায় তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। সংসারে সময় দিতে পারে না।

“এখন আমাদের জীবনে সেই কষ্টের শেষ হবে। সন্তানদের একটা স্থায়ী পরিচয়  হবে।”

এক সময় বাসায় কাজ করে জীবন চালানো সত্তরোর্ধ্ব মহিরন বেগম জানান, অনেক বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন, তিন ছেলেকেও অকালে হারিয়েছেন। দুই মেয়ে নিজেদের বিয়ের পর আর কোনো খোঁজ-খবর রাখে না। এই ঘর তার জীবনে একটা অবলম্বন হয়ে এসেছে।

এদের মতো ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আশ্রয়ন নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যা তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ ৩ লাখ ২০ হাজার ৫২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।

এবার মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। তার এই ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়।

এ লক্ষ্যে গত বছর জুনে সারা দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা করা হয়। আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় তাদের জীবন বদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ভূমিহীন, গৃহহীন, অসহায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন এবং তাদের ঋণপ্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য।