চলচ্চিত্র থেকে শিশুরাও যেন শিখতে পারে: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শিশুদের জন্য এমনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে, যাতে তারা সেখান থেকে ভবিষ্যত জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা পায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2021, 08:33 AM
Updated : 17 Jan 2021, 11:04 AM

রোববার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ২০১৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “এর মধ্যে দিয়ে কিন্তু একটা শিশু তার জীবনটাকে দেখতে পারবে, জীবনটাকে তৈরি করতে পারবে, বড় হতে পারবে।

“সেদিকে লক্ষ্য রেখেই শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, তার মধ্যে দিয়ে তাদের শিক্ষনীয় বিষয়গুলো প্রতিফলিত করা, এটাও কিন্তু আমাদের করতে হবে।”

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই সামাজিক দায়িত্বটুকু পালন করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সিনেমাগুলো সেইভাবেই তৈরি করতে হবে, যেন পরিবার পরিজন নিয়ে দেখতে পারে।”

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নষ্ট হয়ে যাক- সেটা সরকার কখনো চায় না। এক সময় টেলিভিশন যুগের আবির্ভাবে সিনেমা শিল্প থমকে গেলেও এখন আবার সিনেমার যুগ ফিরে এসেছে।

“শুধু বাংলাদেশেই না, এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষ সিনেমা দেখছে। হয়ত হলে যায় না, ঘরে বসে দেখে। কিন্তু হলেও আমাদের মানুষ টানতে হবে। আর মানুষ যাতে আসে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।”

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেন চলচ্চিত্র উঠে আসে, সেভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি আপনাদের এটা অনুরোধ করব, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা কিন্তু ১৫ই অগাস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর বিকৃত করা হয়েছে। কাজেই ইতিহাসটা যেন সবাই জানে।

“আমরা তো বীরের জাতি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। কাজেই আমাদের সেই বিজয়ের ইতিহাসটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন মনে রাখতে পারে, সেই ধরনের চলচ্চিত্র আরো নির্মাণ হওয়া দরকার।”

ছবি:পিএমও

সরকারপ্রধান বলেন, “আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি- সেগুলো যেমন থাকবে, আবার বিশ্বের সাথে মিলিয়ে চলার জন্য… সেগুলোও থাকতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে যাতে সেগুলো গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু পাশপাশি আমাদের যে মহান অর্জন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি… আমাদের সেই বিজয়ের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আমাদের চেতনা, আমাদের যে আদর্শ, আমাদের নীতি, সেগুলো প্রতিফলিত হওয়া একান্ত দরকার।”

সমাজ গঠনে চলচ্চিত্রের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি জানি, আমি একজন রাজনীতিবিদ। যত বক্তৃতা দিয়ে একজন মানুষকে যত কথাই বলি না কেন, কিন্তু একটা নাটক বা একটা সিনেমা বা একটা গানের মধ্যে দিয়ে, একটা কবিতার মধ্যে দিয়ে কিন্তু অনেক কথা বলা যায়, মানুষের অন্তরে প্রবেশ করা যায়, মনের গহীনে প্রবেশ করা যায়। কাজেই সেই জন্য এর একটা আবেদন কিন্তু রয়েছে।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সচেতন করতে দায়িত্ব পালন করায় চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।   

দেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ও প্রসারে জাতির পিতার নেওয়া ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই শিল্পের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপেরও কথাও অনুষ্ঠানে বলেন প্রধানমন্ত্রী।

মহামারীর মধ্যে এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারায় নিজের দুঃখের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি তো আছি সব সময় আপনাদের পাশে। কারণ আমার বাবার হাতে গড়া এফডিসি। এই সিনেমা তৈরি করার যে উৎসাহটা, সেটা তিনি দিয়েছিলেন। কাজেই সেদিকটা মাথায় রেখে সব সময় আমি কাজ করি।”

সমাজে শিল্পীদের একটি ‘আলাদা সম্মান; আছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি আলোচনা করে দেখব যে অন্তত যারা আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন, তাদের সম্মানটা যেন তারা সব সময় পান, সেই ব্যবস্থাটা করার জন্য যা করণীয়, আমরা করব।”

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বা দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সিনেমা শিল্প অনেক অবদান রাখতে পারে। সেইভাবেই আপনারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষকে আরো উদ্বুদ্ধ করা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন আমাদের ইতিহাসটা জানতে পারে, বিজয়ের ইতিহাস জানতে পারে এবং মানুষ যেন ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে আপনারা করবেন।”          

এখন তরুণরা চলচ্চিত্র শিল্পে এগিয়ে আসায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি, আজ আছি কাল নেই। কিন্তু আমাদের তরুণ সমাজ যে সিনেমা শিল্পের দিকে... তাদের আগ্রহ বেড়েছে, তারা যে এগিয়ে আসছে, আমরা মনে করি এটা ভালো লক্ষণ।”    

শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার আজীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনাও প্রধানমন্ত্রী এ অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন।

তিনি বলেন, “১৫ অগাস্ট আমাদের জীবনটাকে পাল্টে দিল। তারপর থেকে আর বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চার সেই গুরুত্বটাই নষ্ট হল, আদর্শটা নষ্ট হল। আমরা যে বাঙালি, আমাদের বাঙালির সংস্কৃতির চিন্তা চেতনাটাও নষ্ট হতে বসেছিল। এটা হল বাস্তবতা।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এরপর আবার দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যেগ নেওয়া হয় বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

আবার বসন্ত সিনেমার জন্য ২০১৯ সালের সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তারিক আনাম খান। ছবি:পিএমও

ন ডরাই চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ২০১৯ সালের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন সুনেরাহ বিনতে কামাল। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রোববার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। ছবি: পিএমও

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন করার উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি এই উদ্যোগ নিয়েছি এই কারণে যে আমি দেখেছি, আমাদের অনেক শিল্পী, যাদেরকে আমি নিজে চিনতাম ভালো করে… আর আমাদের বাসায় সব সময় সকলের একটা অবাধ যাতায়াত ছিল, এমনকি ধানমণ্ডি লেকের সামনে যখন শুটিং হত, তখন সবাই আমাদের বাসায় এসেই বসত, চা-পানি খেত, খাবার খেত। আমার মা সবাইকে আপ্যায়ন করতেন।”

নিজের পরিবারের অনেকে সাংস্কৃতিক জগতের সাথে জড়িত ছিলেন, ফলে শিল্পীদের অনেকের দুঃখ, দুর্দশার চিত্র নিজে চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা। 

তিনি বলেন, “এই কষ্টটা যখন আমি দেখি, আর বিশেষ করে আমার ছোট বোন রেহানা লন্ডনে থাকে, সে অনলাইনে নিয়মিত পত্রিকা পড়ে, কারো কোনো কষ্ট দেখলে সাথে সাথে আমাকে সে খবর পাঠায়। আমি চেষ্টা করি সাথে সাথে ব্যবস্থাটা নিতে। আমি জানি, যখন আমি আছি, আমি হয়ত সহযোগিতা করে যাচ্ছি, কিন্তু যখন আমি থাকব না, তখন কী হবে? সেই চিন্তা করেই কিন্তু আমি এই চলচ্চিত্র কল্যাণ ট্রাস্ট…।”

এই ট্রাস্টের সুফল যাতে সবাই পায়, সে ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, “আইনটি আমরা পাস করব পার্লামেন্টে। এরপর আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটা সিড মানি দেব। আর সেই সাথে আমরা চাইব যে, যারা আছেন চলচ্চিত্রের সাথে, তারাও এখানে আরও অর্থের জোগান দেবেন, যাতে প্রত্যেকে এই ট্রাস্ট থেকে যে কোনো সময়ে তাদের বিপদে, আপদে অনুদান নিতে পারেন। চিকিৎসার থেকে শুরু করে সব কাজ যাতে করতে পারেন।”

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অনুষ্ঠানের সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ অনুষ্ঠানে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান এবং তথ্যসচিব খাজা মিয়াও বক্তব্য দেন।

২০১৯ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্য থেকে ২৫টি ক্যাটাগরিতে মোট ৩১ জনকে এ অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করা হয়।

এছাড়া চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) ও কোহিনুর আক্তার সুচন্দা এ বছর আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন।