কাকরাইলে মা-ছেলে হত্যায় তিন আসামির ফাঁসির রায়

ঢাকার কাকরাইলে তিন বছর আগে মা-ছেলে খুনের ঘটনায় নিহত নারীর স্বামী, তার তৃতীয় স্ত্রী এবং শ্যালকের ফাঁসির রায় হয়েছে।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2021, 05:58 AM
Updated : 17 Jan 2021, 12:13 PM

ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলম রোববার আসামিদের উপস্থিতিতে এই রায় ঘোষণা করেন।

২০১৭ সালের ১ নভেম্বর কাকরাইলের পাইওনিয়র গলির ৭৯/১ নম্বর বাসায় শামসুন্নাহার করিম (৪৬) ও তার ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওনকে (১৯) গলা কেটে হত্যা করা হয়।

দণ্ডিত তিন আসামি হলেন- শামসুন্নাহারের স্বামী আব্দুল করিম, করিমের তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তা ও মুক্তার ভাই আল-আমিন ওরফে জনি।

সর্বোচ্চ সাজার পাশাপাশি তিন আসামির সবাইকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন বিচারক।

রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, “এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড হল আসামি আব্দুল করিম, যিনি মৃত ভিক্টিম শামসুন্নাহারের স্বামী ও মৃত ভিক্টিম সাজ্জাদুল করিম শাওনের পিতা।

“অথচ আসামি আব্দুল করিম নিজের অসৎ উদ্দেশ্যে ও হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আসামি শারমিন আক্তার মুক্তা ও আসামি মো. আল আমিন জনির সাথে পূর্ব পরিকল্পনা করে আসামি মো. আল আমিন জনিকে দিয়ে নিজ স্ত্রী ও ঔরসজাত নিজ সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করিয়েছে। সে কারণে সকল আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত মর্মে এই আদালত মনে করে।”

এই রায়ের বিরুদ্ধে আপলি করা হবে কি না জানতে চাইলে আসামি করিম আদালত থেকে কারাগারে যাওয়ার সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেটা উকিলের সঙ্গে কথা বলে তিনি ঠিক করবেন।

অন্যদিকে মামলার বাদী ও শামসুন্নাহারের ছোট ভাই আশরাফ আলী রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আশা করছি উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত তাদের দণ্ড কার্যকর হবে।”

শামসুন্নাহারের বড় ভাই আমানুল্লাহ হাওলাদার বলেন, “এই মামলার তদন্ত থেকে রায় পর্যন্ত যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমাদের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের ভিটিশিলমন্দির এলাকার মানুষ এই রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারাও রায়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন।”

রায়ের পর আদালতে আসামি শারমিন আক্তার মুক্তা

মামলার মূল আসামি আল আমিন জনি, ফাইল ছবি

২০১৭ সালের ১ নভেম্বর কাকরাইলের রাজমনি প্রেক্ষাগৃহের পশ্চিম দিকে রাজমনি কার সেন্টার ও বায়রা ডাটাবেইজের মাঝের পাইওনিয়র গলির ৭৯/১ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় শামসুন্নাহার করিম (৪৬) ও তার ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওনকে (১৯) গলা কেটে হত্যা করা হয়। বাড়িটি আব্দুল করিমের। তাদের বড় দুই ছেলে বিদেশে থাকেন।

পুলিশের ভাষ্য, মুন্সীগঞ্জের শামসুন্নাহার (৪৬) ব্যবসায়ী করিমের প্রথম স্ত্রী। পরে ফরিদা নামের এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন করিম। ফরিদার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তিনি মুক্তাকে বিয়ে করেন।

করিম মুদি পণ্যের ব্যবসা ছাড়াও এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের প্রযোজনা ও পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশ সে সময় জানায়।

ওই হত্যাকাণ্ডের পরদিন শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী রমনা থানায় এই হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেখানে করিম, মুক্তা ও জনিসহ অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় করিম ও তার তৃতীয় স্ত্রী মুক্তাকে। পরে তাদের ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এরপর ওই বছরের ৩ নভেম্বর রাতে গোপালগঞ্জ থেকে মামলার মূল আসামি জনিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ছয়দিনের রিমান্ডের মধ্যেই ৮ নভেম্বর জনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে মুক্তাও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ১৬ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার পরিদর্শক মো. আলী হোসেন তিনজনের বিরুদ্ধেই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এরপর ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তিন আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেয় ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত।

এ মামলার বিচারকালে অভিযোগপত্রের ২২ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৭ জনের সাক্ষ্য শোনেন বিচারক। ১২ নভেম্বর তিন আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।

এরপর ১৩ ডিসেম্বর দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শুরু হয়। সেই শুনানি শেষে গত ১০ জানুয়ারি আদালত ১৭ জানুয়ারি রায়ের দিন রাখে।

রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সালাউদ্দিন হাওলাদার বলেন, “হত্যাকারী জনিকে ওই বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন শামসুন্নাহারের স্বামী আব্দুল করিম। তাই তিনি হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড। আব্দুল করিমসহ তিন আসামির সর্বোচ্চ শাস্তিই আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। আদালতের রায়ের তার প্রতিফল ঘটেছে।”

২০১৭ সালের ১ নভেম্বর কাকরাইলের এই বাড়ির পঞ্চম তলায় খুন হন শামসুন্নাহার করিম ও তার ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওন।

আদালতের পর্যবেক্ষণ

আলোচিত এ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক রবিউল আলম বলেন, “সন্তানের আশা ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হল তার পিতা। আর স্ত্রী হলেন সহধর্মিনী, অর্ধাঙ্গিনী ও সন্তানের জননী। সে কারণে প্রত্যেক স্ত্রী তার স্বামীর কাছে সম্মানের পাত্রী। স্বামীর কাছে স্ত্রীর রয়েছে বহুমাত্রিক অধিকার। স্বামী ও স্ত্রী একে অন্যের সহায়ক ও পরিপূরক।”

কোরআন থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “সূরা মায়িদাহর ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে অন্য কোনো প্রাণের বিনিময় ব্যতীত কিংবা পৃথিবীতে কোনো ফ্যাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করল।

“উপর্যুক্ত অবস্থায়, এই আদালত মনে করে, মৃত্যুদণ্ডই এই আসামিদের উপযুক্ত ও একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিৎ।”

আসামিদের সবাইকে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা ও ৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় রায়ে।

দুই আসামি শারমিন আক্তার মুক্তা ও তার ভাই আল আমিন জনির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির উল্লেখ করে বিচারক বলেন, “শামসুন্নাহারকে রান্না ঘরে আটকে তারপর ছুরি নিয়ে মারতে গেলে তার ছেলে শাওন তা দেখে ফেলে ও বাধা দেয়। এই খুনের পরিকল্পনা করেন তিনজন মিলেই। আর বাস্তবায়ন করেন মুক্তার ভাই জনি। তিনি একাই ছুরি মেরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন। শাওনের রক্ত মাখা ক্যাপ ও ফুল শার্ট উদ্ধার করা হয় পাশের নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে।”

মামলার শুনানিতে আসামিপক্ষ যুক্তি দিয়েছিল, শামসুন্নাহারের সঙ্গে আব্দুল করিমের আর দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল না। করিম ঘটনাস্থলেও উপস্থিত ছিলেন না।

এ বিষয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণে এসেছে যে আব্দুল করিম হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টার মাইন্ড’। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতের রেফারেন্স দিয়ে আদালত বলেছে, পরিকল্পনাকারী হিসেবে তার ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকাটা জরুরি নয়। দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সাধারণ অভিপ্রায় থাকাটাই সর্বোচ্চ দণ্ড দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

পুরনো খবর