যা বললেন দিহানের মা-ভাই

রাজধানীর কলাবাগানে স্কুলছাত্রীকে ‘ধর্ষণের পর হত্যার’ অভিযোগে গ্রেপ্তার ফারদিন ইফতেখার দিহানের ভাই বলেছেন, তার ভাই ‘সত্যিই অপরাধ করে থাকলে’ তার ফাঁসি চাইবেন তারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেরুন নাহার মেঘলা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Jan 2021, 07:24 PM
Updated : 9 Jan 2021, 09:01 PM

তিন ভাইয়ের সবার ছোট দিহান (১৮) ‘ও লেভেলের’ ছাত্র। তার বন্ধু রাজধানীর মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ও লেভেলের ওই ছাত্রীকে বৃহস্পতিবার দুপুরে অচেতন অবস্থায় ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি।

হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা মেয়েটিকে মৃত ঘোষণা করেন। যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটির মৃত্যু হয় বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন।

এই মামলায় এরইমধ্যে দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন দিহান। শনিবার কলাবাগানের লেক সার্কাসের ডলফিন গলির বাসায় গিয়ে কথা হয় তার মা সানজিদা সরকার এবং মেজভাই নিলয়ের সঙ্গে।

নিলয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ভাই যদি এমন অপরাধ করে থাকে, তবে তার ফাঁসিও চাইব আমরা।”

ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে সানজিদা সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে শেষ মুহূর্তে বাবাকে দেখব বলে ওই দিন দুই বোনের সাথে গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় রওনা দিই। দিহানকে বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। পথে সিরাজগঞ্জে যাত্রাবিরতির সময় নিলয় আমাকে ফোন করে বলে, মা তুমি যেখানেই থাক, ঢাকায় ফিরে আস। দিহানের একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।

“আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিপদ বুঝতে পেরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেই। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বাসায় এসে দেখি আমার বাসায় পুলিশ।”

তিনি বলেন, “আমি যদি ঘুণাক্ষরেও জানতাম এমন কিছু হবে, কখনও ছেলেকে একা বাসায় রেখে বের হতাম না।”

রাজধানীর কলাবাগানে স্কুলছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার ফারদিন ইফতেখার দিহান ও তার সঙ্গীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে শনিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডি-২৭ নম্বরে বিক্ষোভ করেন মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

দিহানের ভাই নিলয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃহস্পতিবার আমি নারায়ণগঞ্জে কর্মস্থলে ছিলাম। হঠাৎ দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে দিহান আমাকে ফোন করে খুব কান্নাকাটি করে বললো, ওর এক বন্ধু অসুস্থ, তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে এবং আমি যেন যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় আসি। তখনও আমি বিস্তারিত কিছু জানতাম না।

“আমি অফিস থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর ১টা ৫০ মিনিটে দিহান আমাকে আবার ফোন দিয়ে জানায়, ওর বন্ধু মারা গেছে। এই কথা বলে ফোন রেখে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর আমি দিহানকে আবারও ফোন দিলে সে আর ফোন রিসিভ করেনি। ঢাকায় এসে আমি বিস্তারিত জেনেছি।”

দিহানের বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, তিনি গ্রামের বাড়ি রাজশাহী ও ঢাকা- দুই জায়গাতেই থাকেন। বড় ছেলেও বাবার সঙ্গে বেশিরভাগ সময় রাজশাহীতেই থাকেন বলে পরিবরারের সদস্যরা জানান।

দিহান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সঙ্গে এই দুই দিন পরিবারের কারও ‘যোগাযোগ হয়নি’ বলে জানান ভাই নিলয়। তিনি বলেন, আইনগত সহায়তার জন্য কোনো আইনজীবীও ঠিক করা হয়নি।

দিহানের পরিবার মামলায় ‘প্রভাব খাটানোর চেষ্টা’ করছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা অস্বীকার করেন দিহানের মা।  

তিনি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কথা ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। এ ঘটনার পর আমরা কোনো জায়গা থেকে বিন্দুমাত্র সহযোগিতা পাইনি। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।... বৃহস্পতিবার থেকে আমার বাসায় রান্না পর্যন্ত হয়নি। কেউ এক ফোঁটা দানাপানি মুখে নিই নাই আমরা।”

দিহানের ভাই বলেন, “দিহান ধর্ষক, খুনি হলে ভাই হিসেবে আমি চাই ওর ফাঁসি হোক। কিন্তু ঘটনার পর আমাদের পরিবারকে নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার মাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কথাও বলা হচ্ছে। আমাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অথচ পরিবারের কেউই ঘটনাস্থলে ছিলাম না, জানতামও না।”

কলাবাগানের যে বাসায় দিহানের পরিবার থাকে, সেই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মোতালেবের সাথে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ঘটনার দিন সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন দুলাল নামের একজন।

ঘটনার পর থেকে তার সঙ্গে ‘যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি’ বলে মোতালেবের ভাষ্য।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই দিন দুপুর ২টার পর থেকে দুলাল নিখোঁজ। সে এই বাড়িতে আর আসে নাই। তাকে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না।”

ঘটনার শিকার মেয়েটির মা অভিযোগ করেছেন, বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে দিহানসহ চারজন ছিলেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিহান যখন আমাকে ফোন দেয় তখন সে বলছিল, তারা চারজন একসাথেই ছিল। কিন্তু থানায় মামলা নেওয়ার সময় ওর বাবাকে নানাভাবে বুঝিয়ে একজনকে আসামি করেই মামলা নেওয়া হয়।”

রাজধানীর কলাবাগানে স্কুলছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার ফারদিন ইফতেখার দিহান ও তার সঙ্গীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে শনিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডি-২৭ নম্বরে বিক্ষোভ করেন মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আ ফ ম আসাদুজ্জামান  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাদীপক্ষ তাদের আইনজীবীর সাথে পরামর্শ এবং যাচাই-বাছাই করে দিহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেই মামলা করেন। এখানে কাউকে নতুন করে যুক্ত করা কিংবা কাউকে বাদ দিয়ে মামলা করার প্রশ্নই আসে না।”

তবে মামলার বাদী মেয়েটির বাবা বলেছেন, “প্রথমে আমি দিহানসহ আরও তিনজনের নাম উল্লেখ করে এজাহার দিলে পুলিশ তাদের আটক করে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর কলাবাগান থানা পুলিশ আমার দেওয়া এজাহার পরিবর্তন করে শুধু দিহানকে আসামি করে মামলা রেকর্ড করে।

“সে সময় পুলিশ আমাকে বলে, যেহেতু দিহানের বাসা থেকে ঘটনাটি ঘটেছে, সেই কারণে শুধু দিহানকে আসামি করে মামলা করলে সঠিক বিচার হবে।

“কিন্তু চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে যতটুকু জানতে পেরেছি, মেয়ের উপর যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, তাতে এই ঘটনার সাথে কোনোভাবেই একজন জড়িত নয় বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি দিহান ঘটনার সময় একাই ছিলেন এবং পরবর্তীতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লে তার অন্যান্য বন্ধুসহ মেয়েটির পরিবার এবং দিহানের নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন বলে স্বীকার করেন।”

দিহানের বিরুদ্ধে অন্য কোনো অভিযোগ পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তদন্ত কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন জায়গায় আমরা অনুসন্ধান টিম পাঠাচ্ছি। তাদের অনুসন্ধানে এমন কিছু জানা গেলে অবশ্যই তা আমরা জানাব। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনা ভিন্ন অন্য কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি।”

পুলিশ মেয়েটির বয়স বেশি দেখাতে চেয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন তার মা।

তিনি বলেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর দিহান তার মেয়ের বয়স ‘১৯ বছর’ উল্লেখ করেছিল। পুলিশ সেটাই ধরছিল।

পুলিশ ওই দিন বিকাল ৪টার দিকে সুরতহাল প্রতিবেদন করাসহ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। বিকাল ৫টায় ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগ লাশ গ্রহণ করে।

মেয়েটির মা বলেন, “এ সময় সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা বয়স নিয়ে আমরা আপত্তি তুললে পুলিশ ক্ষুব্ধ হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মর্গে লাশ ফেলে রাখে।

“পরদিন শুক্রবার বয়স প্রমাণের জন্য লাশ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় পুলিশ। আমি আমার পরিচিতি বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষীর সাহায্যে হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানাই। এরপর বিকাল সাড়ে ৫টায় ময়নাতদন্ত শেষ করে আমাদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে।”

তিনি জানান, তার মেয়ের জন্মের পর ইস্যুকৃত টিকা কার্ড, স্কুল কার্ড এবং সর্বশেষ পাসপোর্টে তার মেয়ের জন্ম তারিখ ২০০৩ সালের ৯ অক্টোবর লেখা আছে। সে হিসেবে মৃত্যুর সময় বয়স হয় ১৭ বছর ৩ মাস।

“পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টে ১৯ বছর বয়স কোথায় পেলেন?,” প্রশ্ন করেন তিনি।

মেয়ের বয়সের প্রমাণপত্র দেখালেও পুলিশ তা আমলে নিচ্ছিল না বলে অভিযোগ করেন মা।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে এবং বিভিন্ন পরীক্ষার সময় হাসপাতালে যে বয়স দেখানো হয়, সেখানে ১৯ বছর বয়স লেখা হয়েছে। হাসপাতালে পেপার্সে স্কুলছাত্রীর স্বজনের স্বাক্ষরও আছে।

“এটা পুলিশের প্রাথমিক সূত্র। এখান থেকে পুলিশ বয়সের তথ্য নিয়েছে। এছাড়া তার বয়স নির্ধারণের জন্য তার নমুনাও নেওয়া হয়েছে। এটার রিপোর্ট পাওয়া গেলে বয়স কত তা জানা যাবে।”

বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৬ বছরের নিচে কোনো মেয়ের সম্মতি নিয়ে যৌন সম্পর্ক গড়লেও তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হয়। আবার দেশে ১৮ বছরের নিচের বয়সীরা শিশু হিসেবে আইনিভাবে স্বীকৃত।

দিহানকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলেছিল, ‘পারস্পরিক সম্মতিতে’ শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছে ওই তরুণ।

তবে মেয়েটির বাবা মামলায় অভিযোগ করেছেন, তার মেয়েকে কলাবাগান ডলফিন গলির বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন দিহান। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে অচেতন হয়ে পড়লে বিষয়টি ভিন্নখাতে নেওয়ার আসামি নিজেই তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যান।

শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে মেয়েটির ময়নাতদন্ত হওয়ার পর ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, “তার শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া না গেলেও যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথে ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। বিকৃত যৌনাচারের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে।”

ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের সদস্যরা মেয়েটির মরদেহ নিয়ে যান। শনিবার সকালে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার কমলাপুরের গোপালপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।