বিনা দোষে বন্দি: আরমানকে এখনই মুক্তি ও ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ

নির্দোষ হয়েও ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর ধরে কারাবন্দি পল্লবীর বেনারসীর কারিগর মো. আরমানকে এখনই মুক্তি এবং ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2020, 12:52 PM
Updated : 31 Dec 2020, 03:49 PM

আরমানের আটকাদেশ অবৈধ এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় দিয়েছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজি) ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্দেশ প্রতিপালনের হলফনামা দাখিল করতে বলা হয়েছে।

এছাড়া আরমানকে গ্রেপ্তার এবং তার জেল খাটার ঘটনায় চার পুলিশ কর্মকর্তার দায় নিরূপন এবং দায় থাকলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ডিআইজিকে একটি কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।

এই কমিটিকে আগামী তিন মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আগামী ১১ এপ্রিলের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে।

ওই চার পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- পল্লবী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দাদন ফকির, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম, উপ-পরিদর্শক নজরুল ইসলাম ও মো. রাসেল।

তাদের বর্তমান দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে ‘ক্লোজ’ করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।

সেই সাথে বলা হয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত রাখতে।

আদালতে এ মামলায় শুনানি করেন আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির পল্লব। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোজাম্মেল হক ও মাজেদুল কাদের। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী।

রায়ের পর আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির পল্লব সাংবাদিকদের বলেন, “আরমানকে এখনই মুক্তি ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি তৎকালীন চার পুলিশ কর্মকর্তার দায় নিরূপনে তদন্ত কমিটিকে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।

“এই তদন্ত কমিটি ভুক্তোভোগী আরমান, আরমানের পরিবার এবং অভিযোগ ওঠা পুলিশ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের জবানবন্দি নিয়ে তদন্ত করবেন।”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ঘটনায় চার পুলিশ কর্মকর্তার দায় থাকলে সে দায় গোটা পুলিশ বিভাগের ওপর বর্তায় না। ফলে রায়ে আরমানকে ক্ষতিপূরণ দিতে আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন, কেবল সে অংশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।”

‘কারাগারে আরেক জাহালম’ শিরোনামে গত বছর ১৮ এপ্রিল দৈনিক ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

সেখানে বলা হয়, অপরাধী না হয়েও পাটকল শ্রমিক জাহালমকে জালিয়াতির ৩৩ মামলার আসামি হয়ে ৩ বছর কারাভোগ করতে হয়েছিল। অনেক ঘাটের জল পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে তিনি কারামুক্ত হন। এর রেশ না কাটতেই আরেক জাহালম কাণ্ড বেরিয়ে এসেছে ‘আমাদের সময়’ এর অনুসন্ধানে।

“জানা গেছে পল্লবীর বেনারসী কারিগর মো. আরমান নির্দোষ হয়েও ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে ৩ বছর ধরে কারাভোগ করছেন। রাজধানীর পল্লবী থানার একটি মাদক মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি মাদক কারবারি শাহাবুদ্দিন বিহারি এ মামলার প্রকৃত আসামি। কিন্তু তার পরিচয়ে, তার পরিবর্তে সাজা ভোগ করছেন আরমান।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু বাবার নামে মিল থাকায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে শাহাবুদ্দিন নামে আদালতে সোপর্দ করেছে বলে জোর অভিযোগ করেছে তার পরিবার। অন্যদিকে প্রকৃত আসামি শাহাবুদ্দিন কারাগারের বাইরে দিব্যি মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন।

পুলিশের ভুলে অথবা গোপন কারসাজিতে মৃত ইয়াছিন ওরফে মহিউদ্দিনের ছেলে শাহাবুদ্দিনের পরিবর্তে দীর্ঘ ৩ বছর ধরে কারাগারে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন আরমান।

শুধু বাবার নামে (মৃত ইয়াছিন) মিল থাকায় শাহাবুদ্দিনের বদলে পল্লবীর ১৩ হাটস, ব্লক-এ, সেকশন-১০ তেজগাঁও নন লোকাল রিলিফ ক্যাম্পের বাসিন্দা মৃগীরোগী আরমানকে বিনা অপরাধে সাজা ভোগ করতে হচ্ছে।

২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সকালে আরমানকে গ্রেপ্তার করে পল্লবী থানা পুলিশ। এর তিন দিন পর তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। সেই থেকে তিনি কারান্তরীণ। আর সাজাপ্রাপ্ত মাদক কারবারি শাহাবুদ্দিন বিহারি এখনও রাজধানীর মিরপুর ১০, ১১, ১২ ও মোহাম্মদপুর এলাকায় মাদক ব্যবসা করছেন।

আমাদের সময়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৫ সালের ৩০ অগাস্ট গভীর রাতে পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের ৮ নম্বর লেনের ৭ নম্বর ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে ৪০টি ফেনসিডিলসহ শাহাবুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশের ৭ নম্বর টিম।

তিনি তখন সপরিবারে সেখানে বসবাস করতেন। ডিবির পরিদর্শক আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে চলা ওই অভিযানে শাহাবুদ্দিন ছাড়াও গ্রেপ্তার হয় তার দুই সহযোগী সোহেল মোল্লা ও মামুন ওরফে সাগর। তাদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মাদকদ্রব্য আইনের ১৯(১)/৩(ক) ধারায় মামলা হয়।

ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন ডিবি পুলিশের এসআই মো. সিরাজুল ইসলাম খান। মামলায় দুবছর জেল খেটে ২০০৭ সালের ৫ মার্চ জামিন পান শাহাবুদ্দিন।

২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে স্বাক্ষরযুক্ত জামিননামার মাধ্যমে জামিন নেন। জামিনদার হন তার ভাই মানিক। কিন্তু এর পর তিনি আর আইনের মুখোমুখি না হয়ে ফেরারি হয়ে যান।

ওই মামলায় ২০১২ সালের ১ অক্টোবর শাহাবুদ্দিন ও তার দুই সহযোগীর প্রত্যেকের ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেন জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী ঢাকার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফারুক আহম্মদ। পলাতক শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।

২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পল্লবীর ১৩ হাটস, ব্লক-এ, সেকশন ১০ নম্বর এলাকায় অভিযান চালায় পল্লবী থানার পুলিশ। এ অভিযানে ছিলেন তৎকালীন ওই থানার এসআই রাসেল, যিনি বর্তমানে মিরপুর মডেল থানায় কর্মরত। আরমান বাসায় নাশতা সেরে চা পানের জন্য পাশের একটি চায়ের দোকানে যান। অভিযানকারীরা সেখান থেকে তাকে আটক করেন।

এই প্রতিবেদন যুক্ত করে আরমানের মা গত বছর জুলাইয়ে আদালতে রিট আবেদন করেন। সেখানে আরমানের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি তার জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। প্রাথমিক শুনানির পর হাই কোর্ট রুল জারি করে।

পল্লবীর বেনারসীর কারিগর মো. আরমানকে বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়নি, তা নিশ্চিত করতে কেন তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

সেই সঙ্গে আরমানের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং কেন তাকে মুক্তি ও ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।

জারি করা এ রুল যথাযথ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার রায় দিল উচ্চ আদালত।