বিষবৎ বিশ পেরিয়ে একুশে পা

বিদায় নিল ২০২০ সাল; অস্বাভাবিক একটি বছর; বিশ্ববাসীর কাছে যা ছিল বিষবৎ, ব্যতিক্রম ছিল না বাংলাদেশেও। শতাব্দি পর এক মহামারী গোটা বিশ্বকেই করে তুলেছিল তটস্থ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2020, 06:00 PM
Updated : 31 Dec 2020, 06:00 PM

মহামারী ক্যালেন্ডার ধরে আসে না, তবুও ২০২০ সাল দ্রুতই ফুরোক এমনটিই চাওয়া হয়ে উঠেছিল।

২০২০ সালটি ‘খুব খারাপ’ গেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভাষায়- “পৃথিবীর সব মানুষ পারলে অনেক আগেই এটাকে ঠেলে বিদায় করে দিত!”

সেই ২০২০ সালের শেষ সূর্য ডুবেছে, ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজতেই শুক্রবার এসে গেল, শুরু হল ২০২১ সাল। মহামারীকালে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে নানা গণ্ডির মধ্যে থেকে নতুন বছর বরণ করল বিশ্ববাসী; বাংলাদেশেও তাই। তবে শীতে নতুন করে ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির গতি নতুন বছরের যাত্রাকে করে তুলেছে শঙ্কিত।

নতুন সূর্য হাসতে যাচ্ছে, দুঃস্বপ্নের আঁধার কাটার সারথী হিসেবে তাকে ঘিরেই এখন চলছে নতুন স্বপ্নের বুনন। আর তাই ধ্বনিত হয়েছে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নববর্ষের বাণীতে।

সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেছেন, “মহামারির ভয়াবহতাকে মোকাবেলা করে নতুন বছরে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ- নববর্ষে এ প্রত্যাশা করি।”

মহামারীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণীতে।

তিনি বলেছেন, “নতুন বছর ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোরদার করুক, সকল সঙ্কট মোকাবেলার শক্তি দান করুক এবং সকলের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি- এই প্রার্থনা করি।”

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী দিনে আতশবাজিতে রঙিন হয়েছিল ঢাকার আকাশ, পরে সেই রঙ ঢাকা পড়ে মহামারীতে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

অথচ বাংলাদেশে ২০২০ সালের শুরুটা হয়েছিল উৎসবের একটি আবহ নিয়ে; দেশের সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণের সঙ্গে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী; নানা উদযাপনে বছরটিকে স্মরণীয় করে রাখাই ছিল লক্ষ্য।

নানা কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল বছরের শুরুতে; কারণ জানুয়ারিতে চীনের উহানে অজানা এক ভাইরাস সংক্রমণের খবর এলেও বাংলাদেশে তখনও আতঙ্ক হানা দেয়নি। কিন্তু চীন থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়লে দ্রুতই পাল্টে যায় দৃশ্যপট, যেন খুলে গেল গ্রিক পুরানের সেই প্যান্ডোরার বাক্স।

থমকে যাওয়া বিশ্বে নানা দেশ থেকে বাংলাদেশিরা ফিরতে থাকে দেশে; তাতে কোয়ারেন্টিন নামে শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠে সবাই। সংক্রমণ এড়াতে সেই কোয়ারেন্টিন মানাতে গিয়ে দেখা দিয়েছিল বিড়ম্বনাও।

এই ফেরার মিছিলে যারা ছিলেন, তারাও তখন জানতেন না যে তাদের পুনরায় যাওয়ার পথে যে নেমে আসবে ঘোর অনিশ্চয়তা।

মালয়েশিয়ায় কর্মস্থলে ফিরতে না পারা আনোয়ার হোসেন বলেন, “এখন আয়ের কোনো পথ নেই বলে চরম আর্থিক সঙ্কটে আছি। না পারছি ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে, আর না পারছি কাউকে সেই কথা বলতে।”

কুয়েতে বাংলাদেশি কর্মী যাদের নিয়োগপত্রের (আকামা) মেয়াদ শেষ হয়েছিল, করোনাভাইরাস মহামারীকালে তা আর বাড়ানো হয়নি। চাকরিহারা হয়ে কুয়েতের পাট গুটিয়ে ফিরে আসতে হয় এই বাংলাদেশিদের। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মার্চের শুরুতেও মূল সঙ্কট তার চেহারা খোলেনি। ১১ মার্চ যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯কে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করে, তার তিন দিন আগে বাংলাদেশেও ঘটে গেছে সংক্রমণ। তার ১০ দিন পরে ঘটে প্রথম মৃত্যু।

শুরু হয় অজানা-অদেখা এক জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই; সেই লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে আসে লকডাউন, যাতে বিশ্বের অর্থনীতি হয়ে পড়ে স্থবির।

মার্চের শেষ দিকে এসে বাংলাদেশও নাম লেখায় সেই লকডাউনে, পুরো দেশ ধরা দেয় ভিন্ন এক রূপে। আতঙ্ক আর শঙ্কা মিলিয়ে অচেনা এই দেশে দেখা যায় একের পর এক মৃত্যু, হাসপাতালের পর হাসপাতাল ছুটেও রোগীকে ভর্তি করতে না পারার অভিযোগ আসে। রোগাক্রান্ত মায়ের লাশ ফেলে সন্তানদের পালিয়ে যাওয়ার খবরও শুনতে হয়।

কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যু, শেষ বিদায় দিতে স্বজনরাও নেই; এমন নিদারুণ ঘটনা দেখা গেল মহামারীকালে।

পরিস্থিতি যে কেমন ছিল, মহামারীকালে সৎকারে স্বেচ্ছাসেবাদানে সাহস নিয়ে নামা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের কথায় তা ফুটে ওঠে।

“আপন ভাই, স্ত্রী, সন্তানরা সামান্য একটা ভাইরাসের ভয়ে এত অল্প সময়ে কাউকে ত্যাগ করতে পারে, মহামারী না আসলে আমরা কেউ এটা বুঝতে পারতাম না।”

অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও; বাস-ট্রেনের চাকা থেমে যায়, বন্ধ হয়ে যায় বিমানের ওড়া। অতিক্ষুদ্র এক জীবাণুর ভয়ে ঘরবন্দি জীবনে ঢুকে যেতে হয় মানুষকে। সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার চিরায়ত প্রথা ভেঙে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মন্ত্র।

এমন বিরান ঢাকা নিউ মার্কেট কি কেউ আগে দেখেছে? ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সব কাজ থেমে যাওয়ায় কাজ হারিয়ে অনেকের বেকারত্বের জীবনের উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো। এই সময়েই নগর জীবনের স্বপ্ন ভেঙে যায় অনেকের, দেখা যায় বেদনা নিয়ে গ্রামে প্রত্যাবর্তনের পালা। দুই মাস পর কিছু অফিস খোলে, তারপর বাস-ট্রেন চলতে শুরু করে। তবে যে ছন্দ হারিয়ে ফেলার ভীষণ অসময়ে প্রাত্যহিক জীবনে সেই চলায় ছন্দ এখনও ফেরেনি।

এই মহামারী নগ্ন করে তোলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্য; দুর্নীতি যে তা খুবলে খাচ্ছে, তাও প্রকাশিত হয়ে পড়ে বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

মাস্ককাণ্ডে স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকিতে পড়ার পর সাধারণ মানুষকে দেখতে হয় করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে জালিয়াতিতে কীভাবে অসহায় হয়ে পড়েছে তারা। মোহাম্মদ সাহেদ আর জেকেজি দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় পুরো ‘সেট’ই বদলে ফেলতে হয় সরকারকে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়, “আমরা তো একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিলাম। (মহামারী মোকাবেলায়) সরকারের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়টা করা হয়নি। বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে যে দুর্নীতি দেখা গেল এটাও ভয়ঙ্কর। একটি জিনিস বোঝা গেল, স্বাস্থ্য সেবার জন্য আমাদের প্রস্তুতি খুব কম, বরাদ্দ কম। যে বরাদ্দ রয়েছে, সেটাও দুর্নীতির দ্বারা নষ্ট হয়ে যায়।”

কোভিড-১৯ চিকিৎসার নামে প্রতারণা আর জালিয়াতিতে দেশজুড়ে আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ধরা পড়েন সাতক্ষীরা সীমান্তে; গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব তাকে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে আনে ঢাকায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ত্রাণ দুর্নীতি দেশে সব সময়ই ছিল; কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর মতো সর্বগ্রাসী সঙ্কটেও সেই চিত্র বদলায়নি। হতদরিদ্র জনগণের জন্য সরকারের বরাদ্দও হয় চুরি, আর তাতে আগের মতো জনপ্রতিনিধিদের নামই আসে আগে। সামনে আসে যুব মহিলা লীগের শামীমা নূর পাপিয়ার অপকর্মও। কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে সংসদ সদস্য কাজী সহিদ ইসলাম পাপুলের কীর্তিকলাপও।

এই মহামারীতে রাজনীতি যায় ঘরে ঢুকে, বিস্ময়দৃষ্টিতে দেখতে হয় ৩ লাখের বেশি ভোটারের ঢাকা-১০ আসনে মাত্র ১৫ হাজার ভোট পেয়ে ব্যবসায়ী নেতা শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনকে এমপি হতে। মাত্র ৫ শতাংশ ভোটারকে কেন্দ্রে নিতে পেরেছিল এই উপনির্বাচন।

এই মহামারীর মধ্যেই পুরুষাধিপত্যের সমাজে নারীদের সঙ্কট আরও চরমে ওঠে বলে নারী সংগঠনের নেতারা দাবি করেন; আর তাদের সেই দাবিকে ভিত্তি দেয় সিলেটে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে এক নববধূকে ধর্ষণ কিংবা নোয়াখালীতে ধর্ষিত নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা, যাতে অভিযোগের মূল তীর ওঠে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের দিকে।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে রাজপথে সরব প্রতিবাদ ‍ওঠে, যা সামলাতে সরকারকে আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে। ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ না হলে মৃত্যুদণ্ডের সাজাও যে ধর্ষণ কমাবে না, সেই কথা আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে বলা হলেও নতুন আইনে ‘ধর্ষিত’ শব্দটি বাদ দেওয়ায় সন্তোষও এসেছে।

মহামারীর মধ্যে ধর্ষণ ভয়াবহ ‍রূপ নিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও হয়েছিল জোরালো।

‘ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ’ দেশে গত দুই দশকে অতি পরিচিত শব্দ হলেও অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের পুলিশের গুলিতে ‍মৃত্যুতে দেশজুড়ে ওঠে শোরগোল; আর তাতে কক্সবাজারে ইয়াবা পাচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে আরও জোরেশোরে।

পাশাপাশি কুমিল্লার মুরাদনগরে হামলা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে তৈরি করেছে ক্ষত। ধর্ম অবমাননার হুজুগে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা কিংবা ভাস্কর্যের বিরোধিতার রব মৌলবাদী শক্তির মাথাচাড়া দেওয়ার শঙ্কাও জাগিয়েছে।

মহামারীর মধ্যে প্রকৃতিও যেন বেসামাল হয়ে ওঠে; আর তাই ভেঙে ভেঙে টানা চার দফায় হানা দেয় বন্যা; ভাসায় ৩৩টি জেলাকে, প্রায় ৬০০০ কোটি টাকার ক্ষতি করে দিয়ে যায় অর্থনীতিতে।

অর্থনীতিতে মহামারীর আঁচ পড়ছিল এপ্রিলেই, যখন দেশের রপ্তানি আয় নজিরবিহীনভাবে রেমিটেন্সের অর্ধেকে নেমে এসেছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে আসে সরকার; সমালোচনার মধ্যেও রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়।

মহামারীতে বড় বড় যেসব প্রকল্প গতি হারিয়েছিল, সেগুলোর কাজে গতি ফেরানো হয়, আর তারই ধারাবাহিকতায় দৃশ্যমাণ হয় ‘স্বপ্নের’ পদ্মা সেতু। শুরুতে গতি হারানো রেমিটেন্সে একের পর এক রেকর্ড দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়নকে পৌঁছায় অনন্য উচ্চতায়। রপ্তানি বাণিজ্যও স্থিতিশীল হয়ে আসতে থাকে।

পদ্মা সেতুর টু-এফ নম্বর স্প্যানটি বসানো হয় মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর। যে ৪১টি স্প্যান বসিয়ে পুরো সেতু তৈরি হচ্ছে, এটি ছিল তার সর্বশেষ। ফলে এই স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়েই সেতুর মূল কাঠামোর পুরোটা দৃশ্যমান হয়েছে।

মহামারীর ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতির পথে ফেরা প্রশংসিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও; যার কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সরকারের কাজেও গতি হারাতে দেননি তিনি; আর তা এগিয়ে গেছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র উপর ভর করে।

ভিডিও কনফারেন্স কিংবা ভার্চুয়াল সভায় সক্রিয় থেকেছে প্রশাসন; দেশে প্রথম দেখা গেছে ভার্চুয়াল আদালত, যেখানে বিচারক, আইনজীবী, আসামির সরাসরি উপস্থিতি ছাড়াই চলে বিচার কাজ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ ঢুকে যায় গুগলে; শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যার যার ঘরে থেকেই তার মধ্যদিয়ে চলে পাঠদান।

স্কুলে শিশুদের এমন স্বাভাবিক ছুটোছুটি মহামারীকালে হয়ে উঠেছিল অস্বাভাবিক। টানা বন্ধের মধ্যে স্কুল ফিডিং প্রকল্পের বিস্কুট নিতে ঢাকার গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে এই শিক্ষার্থীরা মেতেছিল খেলায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

জাফর ইকবাল লিখেছেন, “কে জানত পুরোপুরি ঘরে আটকা থেকেও ইন্টারনেটে এত রকম মিটিং করা যায়! আমি নিজের দেশে তো বটেই পৃথিবীর আরও কত দেশে যে কত রকম মিটিং করেছি, কত বক্তৃতা দিয়েছি, সেটা বলে শেষ করা যাবে না।”

পরিবর্তিত অবস্থায় সেমিনারগুলো রূপ নেয় ওয়েবিনারে; চলচ্চিত্র-নাটক খুঁজে নেয় ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্ম। ই-কমার্সে আসে নতুন নতুন উদ্যোক্তা, ঘরে বসে অনলাইনে কেনাকাটাও যায় বেড়ে।

ভাইরাস থেকে বাঁচতে অন্য সবার মতো শিশুরাও ছিল ঘরবন্দি, পাশের ফ্ল্যাটের বন্ধুটির সঙ্গেও খেলা বারণ, তাই বেলকনিতে হাত নেড়ে নেড়ে চলে গল্প। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

যে কোনো সঙ্কটই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার যে খুলে দেয়, তা করোনাভাইরাস মহামারী আবার দেখিয়ে দিল।

বিশ্ব হাতে ধোয়া দিবস পালন করে যখন হাত ধোয়ায় সচেতন করা যাচ্ছিল না, তখন এই মহামারী সেই সচেতনতা গড়ে তুলতে রেখেছে ইতিবাচক ভূমিকা।

মুহাম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, “করোনার কালে যে ভালো কিছু একেবারেই ঘটেনি, তা নয়। ২০২০ সালকে শুধু গালাগাল করা মনে হয় ঠিক হবে না। এই বছরের করোনার সময় দেশের অনেক মানুষের ভেতরকার শুভ বোধগুলো নূতন করে প্রকাশ পেয়েছে। অন্যকে সাহায্য করার জন্য কত ভিন্ন ধরনের কাজ মানুষ করেছে, সেগুলো দেখে মানুষের মনুষ্যত্ববোধের উপর নূতন করে বিশ্বাস ফিরে এসেছে।”

গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী এস এম ওয়ালিউল ইসলাম ঢাকার তোপখানা সড়কে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে কেউ তার কাছে যায়নি। পরে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্য আরিফুল আরও একজনের সহযোগিতায় হাসপাতালে নিয়ে যান এই সরকারি কর্মকর্তাকে। কিন্তু তার আগেই তার মৃত্যু হয়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই সংক্রমণ এড়াতে স্যানিটাইজার নিয়ে পথে পথে নামতে দেখা গেছে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের। অপ্রতুল সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। যখন স্বজনরা ভয়ে লাশের কাছে ঘেঁষছিল না, তখন একদল সাহসী মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে সৎকার করতে। খাবার অভাবে বেওয়ারিশ কুকুরকে খাওয়াতে দেখা গেছে মহৎপ্রাণ মানুষগুলোকে।

মহামারীকালে সঙ্কটে ছিল ঢাকার কুকুরগুলোও; তাদের খাবার দিতে নামে শিক্ষার্থীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

যে পুলিশ এত সমালোচিত, এই সেই বাহিনীকেও জনগণ নতুন করে চিনতে শিখেছে এই মহামারীতে। কোয়ারেন্টিনের বিধি-নিষেধ বাস্তবায়ন, বিভিন্ন ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া, অসুস্থদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া- এই সব করতে গিয়ে অনেক পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে, মারাও গেছেন বেশ কয়েকজন।

পাওয়া-না পাওয়ার এই সব হিসাব চুকিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় ২০২০ সাল গত হলেও মহামারীর এখনও শেষ হয়নি। বরং শীতে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়া এবং রূপ বদলে ভাইরাসটির আরও সক্রিয়তা আতঙ্কই আবার ফিরিয়ে এনেছে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “সারা পৃথিবীর জন্য চ্যালেঞ্জ কোভিড-১৯ মহামারী। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের এগোতে হবে।”

নতুন বছরে সরকারের অগ্রাধিকার নিয়ে তার পরামর্শ, “স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাততে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের আসল বিষয় হল অর্থনীতি। এটাতে নজর দিতে হবে। কৃষিতেও বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ কৃষি আমাদের রক্ষা করবে।”

আজিজুল ইসলাম একজন নিরাপত্তাকর্মী; করোনাভাইরাস সঙ্কটে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় হেঁটেই যান অফিসে। বাসা হতে কাজে যাওয়ার মাঝে মাগরিবের সময় হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটপাতেই নামাজে বসে যান তিনি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা হিসেবে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলার লড়াইয়ে থাকা ডা. মুশতাক হোসেনের মতে, দেশের উন্নয়নের ‘এজেন্ডায়’ স্বাস্থ্যকেও যুক্ত করতে হবে।

“স্বাস্থ্য বলতে শুধু হাসপাতালের ভেতরে চিকিৎসাই নয়, তার আগে আমাদের স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধ করতে স্বাস্থ্য কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। স্বাস্থ্য খাতকে লক্ষ্য রেখেই উন্নয়নটা করতে হবে।”

মহামারীর চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববাসীকে এক হয়ে লড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “করোনা মহামারী বিশ্ববাসীকে এক কঠিন বার্তা দিয়েছে। যতই উন্নত হোক না কেন, একা কোনো দেশ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমেই যে কোনো বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা করা সম্ভব। আমাদের সকলকে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।”

ঢাকায় ভরদুপুরে চন্দ্রিমা উদ্যানে ঘুমের এমন দৃশ্য অচেনা নয়, তবে করোনাভাইরাস সঙ্কটের এই সময়ে সুরক্ষার জন্য মুখে লেগেছে মাস্ক। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

২০২০ সালের অভিজ্ঞতাকে নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় থাকা মুশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, “অনেক অভিজ্ঞতা হল, চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। ২০২০ সালের চ্যালেঞ্জগুলো আমরা মোকাবেলা করলাম। এবার যে শক্তি, সহিস সঞ্চয় করে মোকাবেলা করছি, আগামীতে তা আমাদের কাজে লাগবে।”

বিদায়ী বছরে ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলে সব ‘অপ’ই তো বেরিয়ে এল, সঙ্গে আশা হয়ে এল মানব ইতিহাসে দ্রুততম সময়ে তৈরি টিকা; ভাইরাসের রূপ বদলের চোখ রাঙানির মধ্যে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্নকে বসত দিচ্ছে এই টিকা। কয়েকটি দেশে এরই মধ্যে টিকা দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, বাংলাদেশেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যেই টিকা আসবে, এমন আশাই দেওয়া হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাস্ক, মাস্ক আর মাস্ক; সুরক্ষার মূল অস্ত্র এখন এটাই।

তবে টিকা এলেও মহামারী এখনও শেষ হয়নি, প্রকৃতির উপর মানুষের অত্যাচারও কমেনি। ফলে শঙ্কা এখনও কাটেনি।

তা মনে করিয়ে দিয়ে ডা. মুশতাক বলেন, “আমরা যদি মনে করি যে, এই কোভিড-১৯ সংক্রমণ শেষ হয়ে যাবে আর আসবে না। তাহলে আমরা ভুল করব।”