২০২০: শাস্তি বাড়লেও কমেনি ধর্ষণ-নিপীড়ন

২০২০ সালের শুরুটা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনায়, ব্যাপক প্রতিবাদ হলেও তাতে থামেনি নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2020, 05:12 PM
Updated : 30 Dec 2020, 06:59 PM

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই বছরজুড়ে আলোচনায় এসেছে ধর্ষণ-নিপীড়নের নানা ঘটনা।

ধর্ষণে লাগাম টানতে সরকার শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলেও বেসরকারি সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে এই অপরাধ বেড়ে যাওয়ার তথ্যই আসছে।

ফলে নতুন বছরেও নারীকে নিরাপত্তার জন্য লড়ে যেতে হবে বলে আশঙ্কা অধিকার কর্মীদের।

বিদায়ী বছরের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নামার পর ঢাকার কুর্মিটোলা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। ওই ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে, বিভিন্ন সংগঠনও নানা কর্মসূচি পালন করে।

 

এরপর সেপ্টেম্বরে সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া এক নববধূকে দলবেঁধে ধর্ষণ এবং তার রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালীতে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫৪৬ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। এছাড়া ৯৭৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

আগের বছর ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন নারী ও ৯৮৬ জন শিশু এবং ২০১৮ সালে ৭৩২ জন নারী ও ৪৪৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২৪৭টি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের তথ্য পেয়েছে।

সব ঘটনা সামনে না আসায় ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা এসব পরিসংখ্যানের চেয়ে ‘আরও অনেক বেশি’ বলে মনে করেন নারী অধিকার কর্মীরা।

 

‘দলবেঁধে’ ধর্ষণ, অপহরণের পর ধর্ষণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও এ বছর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

ধর্ষণের ঘটনায় বাবা, নিকটাত্মীয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও ধর্মীয় ব্যক্তিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের জড়িত থাকার তথ্য এসেছে। কোনো কোনো ঘটনায় সহযোগী হিসেবে নারীদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগও রয়েছে।

জানুয়ারির পর ২০২০ সালে নিপীড়নের ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে।

২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক নববধূতে ক্যাম্পাস থেকে তুলে ছাত্রাবাসে নিয়ে ধর্ষণ করেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী।

সিলেটের এমসি কলেজে নববধূকে ধর্ষণে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে এক নারী। ছবি: জয়ন্ত সাহা

 

ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভের মধ্যেই ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর ৩২ দিন আগে বাড়িতে ঢুকে একদল লোক ওই গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে শারীরিকভাবে নির্যাতন চালায় এবং ওই ভিডিও ধারণ করে।

এসব ঘটনায় দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। এমনকি জনসচেতনতা তৈরিতে অক্টোবরে একদিন দেশব্যাপী ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরোধী সমাবেশ করে প্রায় সাত হাজার পুলিশ।

ধর্ষকের বিচার দাবিতে মুখে কালো কাপড় বেঁধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

পোশাক নিয়ে বিতর্ক

নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মধ্যেই কেউ কেউ ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন।

অক্টোবরে ধর্ষকদের ‘শিক্ষা দিতে’ এক ভিডিও বার্তায় হাজির হয়ে উল্টো মেয়েদের ‘অশালীন পোশাককে’ দায়ী করে সমালোচনায় পড়েন চিত্রনায়ক ও ব্যবসায়ী অনন্ত জলিল।

এরপর নভেম্বরে জাতীয় সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিলের আলোচনায় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ধর্ষণের জন্য নারীবাদীদের দায়ী করে বক্তব্য দেন। এজন্য নারীদের পোশাকের দিকেও ইঙ্গিত করেন এই আইনপ্রণেতা।

এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও নিজের মন্তব্যে অনড় থাকেন সাংসদ বাবলু।

ধর্ষণের প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে এই নারী বলেছিলেন, ধর্ষণের সঙ্গে পর্দার সম্পর্ক নেই।

 

এর আগে অক্টোবরের শুরুতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক নারী প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। জেলা প্রেস ক্লাবের সামনে তার ‘ধর্ষণের কারণ পর্দা না, ক্ষমতা’ লেখা প্ল্যাকার্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল।

শাস্তি বাড়িয়ে আইন পাস

অব্যাহত ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়তে থাকায় এ ধরনের শাস্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি মামলাগুলোর দ্রুত বিচারে আইন সংস্কারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।

এছাড়া বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে নারী নির্যাতনের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করারও দাবি উঠে আসে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কমিশন গঠনের দাবি তোলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করে ছাত্রলীগ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

 

নানামুখী দাবির মুখে সরকার এ অপরাধের শাস্তি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে ১২ অক্টোবর ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০০০’ জারি করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে নভেম্বরে জাতীয় সংসদে অধ্যাদেশটি বিল হিসেবে পাস হয়।

অক্টোবরে অধিকার কর্মীদের সরব থাকার মধ্যেই বাগেরহাটে একটি ধর্ষণ মামলার বিচার শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ করে রায় ঘোষণার বিষয়টি আলোচনায় আসে।

তবে শাস্তি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েও ধর্ষণের ঘটনা যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তা দেখা যায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে।

সংবাদমাধ্যমে আসা খবরের ভিত্তিতে তৈরি করা ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরের প্রথম নয় মাসে দেশে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। আর অক্টোবর ও নভেম্বরে ৫৭১টি ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসে।

মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন বলছে, বছরে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে অক্টোবর মাসে।

অক্টোবর ও নভেম্বরে দেশে নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের ৩৭০টি ঘটনা সংবাদপত্রে আসার তথা বলা হয়েছে তাদের প্রতিবেদনে, এর আগের নয় মাসে যা ছিল ৮৭৭টি।

ডিসেম্বরেও নিয়মিতই ধর্ষণ-নিপীড়নের খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এর মধ্যে ১০ ডিসেম্বর লালমনিরহাটে ধর্ষণের পর ‘গর্ভপাতের’ কারণে মসজিদ কমিটি একঘরে করে রাখার পর একটি পরিবার বাড়িছাড়া হয়।

সমাধান
কোথায়
?

ধর্ষণ প্রতিরোধে সাজা বাড়ানোর বিষয়টি আশা দেখাচ্ছে বলে মনে করেন সংসদ সদস্য ও অধিকারকর্মী আরমা দত্ত।

প্রিপ ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক আরমা বলেন, “যেহেতু শাস্তি বাড়ানো হয়েছে, অবশ্যই অপরাধটা কমে আসবে। এসিড নিক্ষেপ যেভাবে কমে গেল, সেভাবে এটাও কমে যাবে।

“এটা তো আসলে একটা মানসিক ব্যাধি। যখন তারা দেখবে এটা খেলা না, এটার একটা চরম শাস্তি হয়, তখন অন্যরাও সচেতন হয়ে যাবে।”

তবে এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খানের।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ধর্ষণের পর মারা গেলে মৃত্যুদণ্ড হবে, এই কথাটা আগেও ছিল। এটা একেবারে নতুনভাবে হয়েছে, তা  কিন্তু না। আগের যাবজ্জীবনটা এখন চলে এসেছে মৃত্যুদণ্ডে। তার মানে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট আগেই ছিল।

“যারা এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তাদের যদি সচেতনই করা না যায়, তাদের মূল্যবোধ-নৈতিকতা ফিরিয়ে না আনা যায়, তাহলে এত সাজা দিয়ে কী হবে? যারা ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে, তারা কখনও পত্রিকা পড়ে না, এ ধরনের আলোচনা, টকশো দেখে না। তারা হয়ত বিনোদনমূলক জিনিসপত্র বেশি দেখে। বিশেষ করে পর্নোগ্রাফিগুলো দেখে।”

শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন থেকে নারী অবমাননাকর সব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হয়।

এক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যন্ত কাজ করতে হবে বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী।

“তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, জানাতে হবে যে, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে মৃত্যুদণ্ড হবে।”

তবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত না করা গেলে কোনো কিছুই কাজে আসবে না বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, “সাজা থাকলেও পুলিশ ম্যানেজ করে বের হওয়া যাবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ম্যানেজ করা যাবে- এই প্রবণতা যতদিন কমানো না যাবে ততোদিন আইন করে লাভ নেই।”

অন্যান্য দেশে কঠোর আইন ও এর প্রয়োগ রয়েছে উল্লেখ করে এলিনা খান বলেন, “আমাদের দেশে আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে। যখন ঘটনা ঘটে আমরা প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারি না। সাক্ষ্য দেবেন যারা, তাদের নিরাপত্তা নাই- এসব কারণে দুর্বলতাগুলো থেকে যায়।

“প্রয়োগের যদি বিধান সঠিকভাবে না থাকে তাহলে সাজা বাড়িয়ে লাভ নেই। আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হতে হবে। সাথে সাথে তৃণমূলে মূল্যবোধ-নৈতিকতা বাড়াতে ঘরে ঘরে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে হবে।”

নোয়াখালীতে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে মারধরের ঘটনা প্রকাশের পর সারা দেশে ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগে কয়েক দিন ধরে প্রতিবাদ করেন ছাত্র-জনতা।

সমানাধিকার ও সম্মানের পাশাপাশি নারীকে ‘মানুষ’ ভাবার তাগিদ দিয়ে মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

“ধর্ষণটা দেশে করোনাভাইরাসের মহামারীর মতোই, সেটা কোনো অংশেই কম না। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। প্রথমেই ঘুরে দাড়ানোর মাইন্ডসেটটা করতে হবে শাসক গোষ্ঠীর।”

কেবল সাজা বাড়িয়ে ধর্ষণের ঘটনা কমানো যাবে না মন্তব্য করে এই আইনজীবী বলেন, “ধর্ষণ প্রতিরোধে ও মনিটরিংয়ে কাজ করতে হবে সরকারকে। পরিবারকে, পুলিশকে, পাবলিক প্রসিকিউটরদের ও আদালতকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে হবে।”