করোনাভাইরাস: বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের সম্ভাবনা কতটা?

মহামারীর উদ্বেগ নিয়ে ২০২০ সাল পার করার পর নতুন বছর আসছে টিকার সুখবর নিয়ে; সেই সঙ্গে দেশেই টিকা উৎপাদনের ভাবনার কথা বলে নতুন আশার সঞ্চার করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সরকারের কর্মকর্তারা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Dec 2020, 03:21 PM
Updated : 21 Dec 2020, 07:59 PM

এখন প্রশ্ন হল, বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আনা গেলে দেশে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা কতটা আছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, দেশের বেসরকারি কয়েকটি ফার্মসিউটিক্যাল কোম্পানির সেই সক্ষমতা এবং প্রস্তুতি আছে।

“তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগও করেছে। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সরকার এ বিষয়ে আলোচনা করছে।”

বাংলাদেশের কোম্পানি গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড নিজেরাই করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। ‘বঙ্গভ্যাক্স’ নাম দেওয়া এ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অপেক্ষায় আছে তারা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের ৫৬টি টিকা ক্লিনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে আছে।

এর মধ্যে রাশিয়ায় স্পুৎনিক-ভি টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের শুরুতে। মার্কিন কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেকের টিকা যুক্তরাজ্যে অনুমোদন পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে ফাইজারের টিকা। এ দুটি দেশে টিকার প্রয়োগও শুরু হয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি মডার্নার টিকাও সে দেশে অনুমোদন পেয়েছে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এখন পর্যন্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। বাংলাদেশ সরকার এই টিকার তিন কোটি ডোজ কেনার জন্য ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সেই টিকা বাংলাদেশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।   

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, করোনাভাইরাসের টিকা যারা তৈরি করছে, তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তি এনে দেশেই তৈরি করা যাবে বলে তারা আশাবাদী।

“আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা আছে। টেকনোলজি ট্রান্সফার করা হলেই দেশে উৎপাদনের কাজ শুরু হবে।”

আর স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তি আর উপাদান এনে টিকা তৈরির সক্ষমতা বাংলাদেশের থাকলেও পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে টিকা যারা তৈরি করেছে সেই কোম্পানির আগ্রহ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের ওপর।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেসব কোম্পানি টিকা দিতে রাজি, তাদের সবাইকেই শর্ত দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশকে টিকা উৎপাদনের সুযোগ দিতে হবে।

“আমাদের শর্ত হল, আমাদের ফ্যাসিলিটি থাকলে তারা বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন বানাতে দেবে। কারণ তাদের সবার তো এত ফ্যাসিলিটি নেই যে পুরো বিশ্বকে বানিয়ে দেবে। বিষয়টি আমরা আমাদের স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করে রেখেছি।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাভাইরাস টিকা বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, নতুন করোনাভাইরাসের টিকা তৈরি হওয়ায় পুরো বিশ্বেই আশা জেগেছে। কিন্তু এ টিকা মানুষের শরীরে কতদিন সুরক্ষা দেবে, সেই প্রকৃত তথ্য এখনও জানা যায়নি। ফলে এ টিকার কার্যকারিতা কতদিন থাকবে তা বলা কঠিন।

“এটার (করোনাভাইরাসের) কোনো টিকাই লাইফ লং না। মডার্নার টিকার কার্যকারিতা তিন মাস, অক্সফোর্ড-স্পুটনিক দুই বছর থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে টিকা দেওয়ার পর দুই বছর না গেলে বোঝা যাবে না এর কার্যকারিতা আসলেই দুই বছরের কিনা।”

ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, টিকাগুলো যে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দেবে না, এটা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। আর সে কারণেই দেশে টিকা তৈরির প্রয়োজন হতে পারে।

“সাধারণ মানুষকে যদি নিয়মিত টিকা দিতে হয়, সেক্ষেত্রে দেশেই উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সরকারি উদ্যোগে ইডিসিএল (এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড) এখনও টিকা উৎপাদনে যায়নি। বেসরকারি কিছু ফার্মাসিউটিক্যালসের এই সক্ষমতা রয়েছে; করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদন করতে পারে এমন সেটআপ তাদের রেডি করছে বলে জেনেছি। এ ব্যাপারে সরকার তাদের সহায়তা করবে।”

ওষুধ শিল্পে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মেধাস্বত্ব-সম্পর্কিত চুক্তির বিধিবিধান বা ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (ট্রিপস) চুক্তি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বৈধভাবেই অন্য দেশে উদ্ভাবিত কিছু ওষুধ স্থানীয়ভাবে বানাতে পারে।

এই সুবিধা নিয়ে মার্কিন কোম্পানি গিলিয়াডের সায়েন্সেসের তৈরি করা রেমডেসিভির উৎপাদন শুরু করেছে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

তবে করোনাভাইরাসের টিকার ক্ষেত্রে ওই সুযোগ মিলবে না বলে জানিয়েছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সালাহ উদ্দিন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, নতুন এবং গবেষণা পর্যায়ে থাকা ওষুধের ক্ষেত্রে এ সুবিধা পাওয়া যাবে না।

“করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির পর সেটি নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। তবে যেসব ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে, দুই-তিন মাসের মধ্যে আরও দুয়েকটা হয়তো আসবে, ওই ভ্যাকসিনের উপাদান যদি আমরা নিয়ে আসতে পারি, তাহলে যাদের টিকা তৈরির প্ল্যান্ট আছে, তারা তা বানাতে পারবে। বাংলাদেশে ইনসেপ্টা এবং পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসের টিকা তৈরির সক্ষমতা আছে।”

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কয়েকটি বড় ওষুধ কোম্পানি টিকা তৈরির জন্য প্রডাকশন লাইন প্রস্তুত রেখেছে; তবে সবকিছু নির্ভর করছে টিকার অনুমোদন পাওয়ার পর।

“অ্যাপ্রুভাল হলে সে প্রসেসটা আমরা শুরু করতে পারব। যে টিকা বানাব তার উদ্ভাবক কোম্পানির সঙ্গে আমাদের অ্যালায়েন্সে যেতে হবে। তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তি নিতে হবে।”

রাব্বুর রেজা জানান, বেক্সিমকো এখনই ভ্যাকসিন তৈরির দিকে যাচ্ছে না। তবে ‘ফ্যাসিলিটি’ রেডি রাখা হয়েছে।

“যখনই জানব এই ভ্যাকসিনটা বানানো যাবে, আমরা খুব দ্রুত এটা করতে পারব।”

অক্সফোর্ডের তৈরি টিকা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদন শুরু হলে বেক্সিমকোর মাধ্যমেই তা বাংলাদেশে আসবে।

এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস বা গ্যাভি এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস বা সিইপিআই বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুষ্ঠুভাবে টিকা সরবরাহের জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি বা কোভ্যাক্স নামে যে প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছে, সেখান থেকেও টিকা পাবে বাংলাদেশ।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সোমবার জানিয়েছেন, আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে কোভ্যাক্সের আওতায় ছয় কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার।