কোভিড-১৯: শীতে বেড়েছে পরীক্ষা, সঙ্গে ভোগান্তি

মাঝে কিছুদিন করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা কমে এলেও শীতের শুরু থেকে সংক্রমণ বাড়ায় পরীক্ষাও বাড়ছে; বিভিন্ন হাসপাতাল এবং নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রে ভিড় করছে মানুষ।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2020, 05:14 PM
Updated : 18 Dec 2020, 05:32 PM

এর মধ্যে গত ১৫ ডিসেম্বর সারাদেশে ১৯ হাজার ৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়, যা দেশে করোনাভাইরাসের মহামারী শুরু হওয়ার পর এক দিনের সর্বোচ্চ। 

সেদিন মোট ১৯ হাজার ৩২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। এটাই এ পর্যন্ত দৈনিক নমুনা সংগ্রহের সর্বোচ্চ সংখ্যা বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র।

দেশে ৪৩টি সরকারি হাসপাতাল, ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ৩২টি বেসরকারি হাসপাতাল, ২৬টি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ১৮টি জিন এক্সপার্ট ল্যাব এবং ১০টি অ্যান্টিজেন টেস্ট ফ্যাসিলিটি মিলিয়ে মোট ১৪০টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে এখন।

মঙ্গলবার ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ১০টা থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু হলেও পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে আসা মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে ভোর থেকে।

মুগদা হাসপাতালে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা দেওয়ার অপেক্ষা

বেসরকারি কোম্পানির চাকুরে সাবেরা খানমসহ তিন নারী ঢাকার খামারবাড়ি থেকে মুগদায় এসেছিলেন নমুনা দিতে।

তারা চার কর্মজীবী নারী এক বাসায় থাকেন। একজন করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ায় বাকিরাও পরীক্ষা করাতে এসেছেন।

সাবেরা বলেন, “আমার গলাব্যথা ছাড়া আর কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু যেহেতু চাকরি করি, প্রতিদিন অফিসে যেতে হয়, তাই নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এ কারণে সবাই মিলে এসেছি।”

বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন জানান, জ্বর আসায় অফিস থেকে তাকে নমুনা পরীক্ষা করাতে বলেছে। সে কারণেই সকালে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন।

“এখানে খুব ভিড় হয়। মাত্র ১৮০-২০০ জনের নমুনা নেয় প্রতিদিন। খুব সকালে এসে লাইন না ধরলে আর নমুনা দেওয়া যায় না।”

সর্বশেষ যে তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিয়েছে তাতে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আরও ১ হাজার ৩১৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ায় দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ২৯৩ জনে।

এক দিনে আরও ২৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় দেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭ হাজার ২১৭ জন হয়েছে।

জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত সময়ে দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজারের ঘরে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তা কমে এসে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজারের ঘরে ছিল।

শীত মৌসুমের শুরুতে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ওঠানামার মধ্য দিয়ে গত ৩০ নম্বর আবার আড়াই হাজার ছাড়িয়ে যায়। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১১০০ থেকে ২৩০০ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। 

 

দেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার আরটি-পিসিআর ল্যাব বাড়লেও সেপ্টেম্বরে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা কমে আসে। জুনের শেষ আর জুলাইয়ের শুরুতে যেখানে দৈনিক ১৭ থেকে ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছিল, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তা ঘোরাফেরা করেছে ১১ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা আবার বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৪৯, নভেম্বরে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪০৯টি এবং ডিসেম্বরের প্রথম ১৬ দিনে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক ঢাকার ৩৮টি এবং চট্টগ্রামের ৬টি বুথের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে এসব নমুনা বিভিন্ন গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়।

ব্র্যাকের গত আড়াই মাসের তথ্যে দেখা যায়, অক্টোবরে ২৩,৪৬২টি, নভেম্বরে ৩২,৪৭০টি এবং ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮,০০৭টি নমুনা সংগ্রহ করেছে তারা।

ব্র্যাক কোভিড-১৯ বুথ কো-অর্ডিনেটর ডা. মিরানা জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শীতে ঠাণ্ডাজনিত রোগ বেড়েছে। এছাড়া মানুষের মধ্যেও নমুনা পরীক্ষা করার প্রবণতা বেড়েছে।

“ঠাণ্ডাজনিত রোগের উপসর্গ কোভিডের মতই, সে কারণে অনেকে নিশ্চিত হতে চাইছেন, ফলে পরীক্ষা আগের চেয়ে বেড়েছে। আর এখন যে কোনো চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গেলেও কোভিড পরীক্ষা লাগে।”

মুগদা হাসপাতালে করোনাভাইরাস পরীক্ষার টিকেট কাউন্টার

 

সরকারি হাসপাতালে ভিড়-ভোগান্তি

নভেল করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য সরকারি হাসপাতালে ১০০ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৩৫০০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আরও অন্তত এক হাজার টাকা বেশি দিতে হয়।

ঢাকায় ১২টি সরকারি, ২২টি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ২২টি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করোনভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা যায়। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ব্র্যাকের ৩৮টি বুথের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করে।

সরকারি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার চাহিদা বেশি থাকলেও শুধু বিএসএমএমইউ, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইনডোর এবং আউটডোরে রোগীর নমুনা নেওয়া হয়। বাকি হাসপাতালগুলো শুধু ভর্তি রোগীর নমুনা নেয়।

বিএসএমএমইউর ফিভার ক্লিনিকে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। এ কারণে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নমুনা দিতে আসা মানুষের ভিড় লেগেই থাকে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা দেওয়ার অপেক্ষা

বিএসএমএমইউ দৈনিক তিনশর বেশি নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে। সাধারণ, স্বাস্থ্যসেবাদানকারী, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, বিএসএমএমইউর কর্মী, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যাংকার এবং বাহিনীগুলোর জন্য কোটা রাখা আছে। এ কারণে সাধারণ কোটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া কিছুটা কঠিন।

১৭ ডিসেম্বর নমুনা পরীক্ষা করার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে বুধবার বিকালে ওয়েবসাইটে ঢুকে সাধারণ কোটায় সুযোগ পাওয়া যায়নি।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করাতে আছে অন্য ঝক্কি। নমুনা দিতে চাইলে আগের দিন সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত একঘণ্টা একটি মোবাইল নম্বরে কল করে সিরিয়াল নিতে হয়। পরদিন সকালে এসে একটি স্লিপ নিতে হয়, নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে নমুনা দেওয়ার লাইনে দাঁড়াতে হয়।

তেজগাঁও থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নমুনা দিতে আসা স্বপন মজুমদার মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, নমুনা দেওয়ার এই প্রক্রিয়া রোগীদের জন্য কঠিন। নিয়ম আরও সহজ ও দ্রুত করা দরকার।

“আমি পরশুদিন এসেছিলাম নমুনা দিতে। কিন্তু সিস্টেম বুঝতেই কিছুটা সময় লেগে গেল। একজন আনসার সদস্যের সহায়তায় নির্দিষ্ট কক্ষের সামনে যাওয়ার পর একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে বললো, পরদিন যেন ওই নম্বরে কল করি। তারপর গতকাল সকাল ৯টা থেকে চেষ্টা শুরু করে লাইন পেয়েছি সাড়ে ৯টায়। আজ সকাল ১০টায় এসে টাকা জমা দিয়েছি। ১১টায় তাদের দেওয়া ফরম ফিলাপ করে বসে আছি। ১২টা থেকে নমুনা নেওয়া শুরু করেছে।”

১৪ মাস বয়সী ওমর ফারুককে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তার মা ও মামা

১৪ মাস বয়সী ওমর ফারুককে নিয়ে তার মা তানিয়া এবং মামা ইসমাইল এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দীতে। ওমরের হৃদযন্ত্রে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হবে। সেজন্য মা-ছেলে দুজনের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে হবে।

ইসমাঈল বলেন, “এখানে এদের প্রক্রিয়াটা জটিল। আমি পরশু এসে অনেক খোঁজ করে জানলাম যে মোবাইলে সিরিয়াল দিতে হয়। কিন্তু ফোন করলে শুধু ব্যস্ত দেখায়। ৪০ মিনিট ধরে চেষ্টার পর কথা বলে সিরিয়াল দিতে পেরেছি। আরেকটা সমস্যা হল ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দেবে বলছে। এটা আরও আগে পেলে আমাদের জন্য ভালো হত।”

চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য কোভিড-১৯ ‘নেগেটিভ’ সনদ দরকার; বেসরকারি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করতে বেশি টাকা লাগে বলে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে এসেছিলেন ওমর ফারুক নামের এক যুবক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “সরকারি হাসপাতালে টাকা কম লাগে, এটা ভালো সুবিধা আমাদের জন্য। কিন্তু সিরিয়াল দেওয়া থেকে শুরু করে রিপোর্ট নেওয়া পর্যন্ত এক সপ্তাহ লেগে যায়।”

তাজিম আহমেদ নামে এক তরুণ জানান, এক আত্মীয়কে রক্ত দেওয়ার জন্য তার কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ প্রয়োজন। কিন্তু বিএসএমএমইউ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম ঘুরেও নমুনা পরীক্ষা করাতে পারেননি।

“বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ওয়েবসাইটে গিয়ে ফরম ফিলাপ করতে বলে, কিন্তু সেখানে সিরিয়াল পারি নাই। বারডেমে করতে হলে সাড়ে তিন হাজার টাকা লাগে। আমার পক্ষে তো এত টাকা দেওয়া সম্ভব না। সেজন্য মুগদায় আসছি। কিন্তু এখানে দেখি বিশাল লাইন।”

আরও পড়ুন