অর্থ পাচার: দুদকের ভূমিকায় অসন্তোষ আদালতের 

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বক্তব্যে আলোচনায় আসা কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারকারীদের নাম ঠিকানা ও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ দেখাতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2020, 03:50 PM
Updated : 17 Dec 2020, 07:11 PM

বৃহস্পতিবার এই সংক্রান্ত দুদকের প্রতিবেদন দেখে হাই কোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন দুদকের কৌঁসুলি মো. খুরশীদ আলম খান। 

প্রতিবেদনটি দেখে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “বিদেশে এত লোক টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কারা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের একজনের নামও পাননি!

“উই ওয়ান্ট টু সি দুদক কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আপনারা অন্ততপক্ষে এটা দেখান যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। টাকা আসবে কি আসবে না, সেটা পরে দেখা যাবে।”

গত ১৮ নভেম্বর ডিআরইউর মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের সত্যতা পাওয়ার কথা জানান।

প্রাথমিকভাবে অর্থপাচারে জড়িত যাদের তথ্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি বলে জানান তিনি। এছাড়া রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ী থাকার কথাও জানান তিনি। তবে তিনি কারও নাম প্রকাশ করেননি।

সে বক্তব্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বাঙালি অধ্যুষিত কানাডার ‘বেগমপাড়া’র প্রসঙ্গ উঠে আসে।

সেসব প্রতিবেদন নজরে আসার পর গত ২২ নভেম্বর হাই কোর্ট অর্থ পাচারকারী, দুর্বৃত্তদের নাম-ঠিকানার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা জানতে চায়।

স্বরাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে তা জানাতে বলা হয়।

এছাড়া প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে অর্থপাচারকারী সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ব্যাংক কর্মকর্তা ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে রুল জারি করে।

নির্দেশ অনুযায়ী বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

দুদক ছাড়া বাকি সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তাহমিনা পলি। 

‘নামটাও জানা যাবে না!’

অর্থপাচারের অপরাধে ২০১৬ থেকে চলতি বছর দুদক কতগুলো মামলা করেছে, কতগুলো অভিযোগ তদন্ত করেছে, কত টাকা বিদেশ থেকে ফেরত এনছে, প্রতিবেদনে সেসব ফিরিস্তি তুলে ধরতে গেলে আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খানকে থামিয়ে দিয়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “এগুলো তো আগে করছেন। পুরাতন কাহিনী বলে তো লাভ নাই। ২২ তারিখের পর (২২ নভেম্বর) কী করেছেন?”

তখন খুরশীদ আলম খান ২২ তারিখের পরের সমস্ত তথ্য যোগ করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বললে বিচার বলেন, “কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?”

প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় বিচারক বলেন, “বহু লোকের নাম আমরা দেখেছি। বিভিন্ন মিডিয়ায় আমরা প্রতিবেদন দেখেছি। অনেক লোকের নাম তো আসছে। এগুলোর উপর ভিত্তি করে বা আপনাদের অনুসন্ধানের পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পারেন কি না?”

জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, “আমাকে যদি মামলা করতে হয় প্রথমত আমাকে এমএলএআর (মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স রিকোয়েস্ট) করতে হবে।”

বিচারক বলেন, “কানাডা, আমেরিকায়, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারকারীরা আছে। তাদের একজনের নামও আপনি পাননি? ইউ ওয়ান্ট টু সি কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। যেটার জন্য রুল ইস্যু করলাম কানাডা, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, মালয়েশিয়ায় তারা বিশাল টাকা পাচার করেছে। অন্ততপক্ষে আপনারা সেটা দেখান যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। টাকা আসবে কি আসবে না, সেটা পরে দেখা যাবে।”

বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারকারী ও দুর্নীতিবাজদের কানাডায় বসতি গড়ার প্রতিবাদে মানববন্ধনও করেছে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। (ফাইল ছবি)

আইনজীবী খুরশীদ আলম খান তখন আবার বলেন, “আমরা এমএলএআর’র জন্য অপেক্ষা করছি না। অভিযোগ পত্র দিয়ে দিয়েছি। ইসমাইল হোসেন সম্রাটের মামলায়…”

বিচারক থামিয়ে দিয়ে বলেন, “আপনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বলছেন। আমরা বলতে চাচ্ছি যারা কানাডায়, মালয়েশিয়ায় তাদের ব্যাপারে কী করছেন, যারা দেশের বাইরে আছে। এই যে নামধাম আমরা শুনছি, বহু টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। টিভিতে আমরা বাড়ি দেখি, পত্রিকায় আমরা বাড়ির ছবি দেখি। কীভাবে তারা এসব করছে? তাদের নামটাও জানা যাবে না? নামটাও জানতে পারব না?”

খুরশীদ আলম খান তখন বলেন, “অবশ্যই অবশ্যই। কেন জানতে পারবেন না। অবশ্যই জানা যাবে। অবশ্যই বিচার হবে মাই লর্ড।”  

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, যে দেশগুলোতে টাকা পাচার হয়, সেই দেশগুলো সহযোহিতা করতে চায় না।

তখন অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, “দেখেন কিছু দিন আগে এই কোর্টেই একটি মামলা করলাম, বাংলাদেশের একজন নাগরিক লন্ডন থেকে কিছু অর্থ নিয়ে এসেছে। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের ওই লোকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেছে এবং তার সমস্ত ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দিয়েছে। যদি ব্রিটিশ সরকার পারে আমরা পরব না কেন?

“যেহেতু আমাদের আইন আছে, আমরা ইনজাংশন দিব, অসুবিধা কী। ওখান থেকে টাকা লেনদেন করতে পারবে না। আমাদের তো সে উপায় আছে। আমরা আদেশ দিয়ে কনসার্ন ব্যাংকে পাঠিয়ে দেব যে, তোমার এই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে ইনজাংশন দেওয়া আছে। তারা কোনো টাকা লেনদেন করতে পারবে না। আমাদের তো ভালো একটা আইন তৈরি করেছে।”

এরপর আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি শুনানির পরবর্তী তারিখ রেখে আদালত আদেশে বলে, “যারা বিদেশে অর্থপাচার করেছে, তাদের কোন জায়গায় কী আছে, কোথায় বসবাস করছেন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্যন্য বিবাদী যারা আছে, তারা এই অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে কি না বা কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানতে চাচ্ছি “

এগমন্ট চুক্তি অনুযায়ী নাম প্রকাশ করা যায় না: অ্যাটর্নি জেনারেল

আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “বিদেশে যেসব মিশন কাজ করে সেসব মিশনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জানানো হয়েছে। মিশনগুলো জানানোর জন্য সময় চেয়েছে। সেই চিঠিটি আদালতকে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে মিশন থেকে জবাব আসলে সে জবাবসহ আদালতে জমা দেওয়া হবে।”

এগমন্ট চুক্তি অনুযায়ী বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) কারও নাম প্রকাশ করতে পারে না জানিয়ে তিনি বলেন, “চুক্তি অনুযায়ী অর্থপাচার সংক্রান্ত কোনো কিছুই আমরা প্রকাশ করতে পারব না আদালতে বা মামলা সম্পর্কিত বিষয়ে। আমরা শুধু তদন্তের কাজে তাদের তথ্য ব্যবহার করতে পারব। তথ্য প্রকাশ করতে গেলে তাদের থেকে অনুমতি নিতে হয়। সেই কারণে আমরা ওদের কাছে অনুমতি চেয়েছি। এর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাইনি, সেটা পেতে একটু সময় লাগবে।”

এক প্রশ্নে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ প্রমাণ ছাড়া কারও নাম বলতে পারে না। জানানোর জন্যই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের সাথে যোগাযোগ করছি। নামগুলো পেলে আমরা জানিয়ে দেব।”

তিনি বলেন, “বিভিন্ন লোক এ নিয়ে কথা বলেছেন, এ কথাগুলো তো আমরা এভাবে আদালতকে দিতে পারি না। তার পরেও আমরা কিছু নাম দিয়েছি। হলফনামা করে বলেছি কার কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আছে, মামলা আছে। তথ্য-প্রমাণসহ যে নামগুলো আমরা পেয়েছি, তার সবগুলোই দিয়েছি আমরা। আশা করছি আগামী তারিখে আমরা ইতিবাচক কিছু দিতে পারব।”

যে প্রতিবেদন দিয়েছে দুদক

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুদক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের অপরাধে ৪৭টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। আর এ সংক্রান্ত ৮৮ টি মামলা তদন্ত করছে দুদক।

দুর্নীতি দমন কমিশন

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৯ সালের কাফরুল থানার এক মামলায় (আরাফাত রহমান কোকোর মামলা) পাচারকৃত প্রায় ২১ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হয়েছে। এছাড়া একই সালের ক্যান্টনমেন্ট থানায় এক মামলায় গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা ফেরত এনে রাষ্ট্রের অনুকুলে জমা করা হয়েছে।

২০১৪ সালে রমনা থানার মামলায় ব্রিটেনে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ৮ লাখ ৮ হাজার ৫৩৮ পাউন্ড জব্দ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের গুলশান থানার এক মামলায় মোরশেদ খানের ১৬ মিলিয়ন হংকং ডলার জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১১ সালের ক্যান্টনমেন্ট থানার এক মামলায় গিয়াস আল মামুনের ৪ লাখ ১৮ হাজার ৮৫৩ পাউন্ড জব্দ করা হয়েছে।

কানাডার এফআইইউ’র কাছে বিএফআইইউ অনুরোধ 

যে সকল বাংলাদেশি কানাডায় অর্থ পাচার করেছে, তাদের নাম ও ঠিকানা যত দ্রুত সম্ভব পাঠাতে কানাডার এফআইইউ’র কাছে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

তা জানিয়েই বৃহস্পতিবার হাই কোর্টে প্রতিবেদন দিয়েছে বিএফআইইউ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট ২০১৫ থেকে ২০২০ অর্থ বছরে দুদক, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ ও এনবিআরকে ৩২২৮টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন দিয়েছে। 

“বিএফআইইউ আন্তর্জাতিক সংস্থা এগমন্ট গ্রুপের সদস্য। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গোপনীয় তথ্য তৃতীয়পক্ষের কাছে দিতে বাধা আছে। তাই বিএফআইইউ তাদের নীতি মানতে বাধ্য। তাদের কোনো নীতি ভঙ্গ হলে সদস্যপদ বরখাস্ত বা বাতিল করতে পারে। যেমনটা ঘটেছে নাইজেরিয়া ও এল সালভাদরের ক্ষেত্রে।”

তবে আদালতের আদেশের পর বিএফআইইউ কানাডার এফআইউ’র কাছে অনুরোধপত্র পাঠিয়েছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “যে সব বাংলাদেশি কানাডায় মানি লন্ডারিং করেছে তাদের নাম ও ঠিকানা দ্রুত পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু এফআইইউ এখনও সাড়া দেয়নি।”

অর্থ পাচারের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তথ্য চেয়ে কানাডার বাংলাদেশ হাইকমিশন বরাবর দুটি জরুরি ফ্যাক্স বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থপাচার সংক্রান্ত ৯৩টি মামলা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

আর সিআইডির তাদের প্রতিবেদনে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কায় অর্থ পাচারের কয়েকটি মামলার তথ্য দিয়েছে।