বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকার জন্য আজও অপেক্ষা

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দুয়ারে পৌঁছেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ শেষ করতে পারেনি বাংলাদেশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2020, 04:18 AM
Updated : 16 Dec 2020, 04:18 AM

মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য নতুন করে যে ১ লাখ ২৩ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল, তার মধ্যে খুলনা বিভাগ বাদে অন্যান্য এলাকার আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই শেষ করেছে সরকার।

তবে এর আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা বিবেচিত হয়ে বেসামরিক গেজেট পেলেও ভালো কোনো রেকর্ড নেই- এমন সাড়ে ৪৩ হাজারের তালিকা নতুন করে যাচাই-বাছাই হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী ৯ জানুয়ারি ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে এই যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি হবে।

আর এই প্রক্রিয়া শেষ হলে বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করা যাবে বলে আশা করছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

গত ২ জুন নতুন করে এক হাজার ২৫৬ জনকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। তাদের নিয়ে স্বীকৃতি পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ৫৬ জন। তবে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় এটাকে ‘প্রকৃত সংখ্যা’ বলা যাচ্ছে না।

মন্ত্রী মোজাম্মেল হক জানান, কোনো না কোনো তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হয়েছেন, এমন সব নাম মিলিয়ে দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৫৬ জন। কিন্তু স্বীকৃতির দাবি করেছেন এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫ জন।

একজনের নাম একাধিক দলিলে থাকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ওই সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি হবে না বলেই মনে করেন মন্ত্রী।

তিনি বলেন, একই নাম একাধিক বানানে লেখার কারণেও একাধিকবার সেসব নাম তালিকায় এসেছে। যাদের নাম একাধিক তালিকায় রয়েছে, তা বাদ দেওয়ার কাজ চলছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (গেজেট) রথীন্দ্র নাথ দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুলনা বিভাগের নতুন আবেদন যাচাই-বছাই এবং সাড়ে ৪৩ হাজার জনের গেজেট যাচাই-বাছাই শেষ না হওয়ায় এখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। সাড়ে ৪৩ হাজার গেজেট যাচাই-বাছাই শেষ হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা জানতে আরও সময় লাগতে পারে।”

ভাতা পাচ্ছেন ১ লাখ ৮৩ হাজার

দেশের ১ লাখ ৭২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এবং ১১ হাজার শহীদ, যুদ্ধাহত ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধকে প্রতি মাসে ভাতা দিচ্ছে সরকার। একজন মুক্তিযোদ্ধা সব মিলেয়ে বছরে ভাতা পান ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা সুফি আব্দুল্লাহিল মারুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগে ১ লাখ ৯২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতি মাসে ভাতা দেওয়া হলেও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) মাধ্যমে এই ভাতা বিতরণ করার এখন ১ লাখ ৭২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন।

“২০ হাজার জনের ভাতা স্থগিত রাখা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে নামের বানানে মিল না থাকা, গেজেটের সঙ্গে অন্য কাগজপত্রের মিল না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে তাদের ভাতা সফটওয়্যারের মাধ্যমে দেওয়া যাচ্ছে না। বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসে ১২ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন।

এর বাইরে দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা, বিজয় দিবসের ভাতা হিসেবে ৫ হাজার টাকা এবং বাংলা নববর্ষে ২ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলয়ে বছরে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ভাতা পান।

বার বার বদলেছে সংজ্ঞা, মানদণ্ড

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্বাধনীতার পর গত ৪৯ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার।

সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত দলিলের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশিত বইয়ে নিয়মিত বাহিনীর ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর ১ লাখ ৭ হাজারসহ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের চার-পাঁচটি তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা চূড়ান্ত রূপ পায়নি।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী বিভিন্ন সেক্টরের তথ্য নিয়ে একটি তালিকা ভলিউম আকারে প্রকাশ করেন, যাতে ৭০ হাজার ৮৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জন কোন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তার কার্যালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথমবারের মতো একটি তালিকা করে।

ওই তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদে ‘লাল বই’ নামে সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে এই তালিকায় ১ লাখ ৫৪ হাজার জনের নাম থাকলেও সবার নামে গেজেট প্রকাশিত হয়নি বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী।

এই ‘লাল বই’য়ে আমিন আহমেদের তালিকার বেশিরভাগের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও কিছু নাম বাদ পড়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তালিকা: ২০০১-২০০৬ পর্যায়

বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে দায়িত্ব না দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনের নেতৃত্বে চারজন সচিব ও খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি করে।

ওই কমিটির দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করে সরকারকে সুপারিশ করা, যাদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।

ওই জাতীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০২ সালের ৪ মার্চ সশস্ত্র বাহিনীর ৩৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘বিশেষ গেজেট’ এবং ১ লাখ ৫৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘গেজেট’ প্রকাশ করা হয়।

বিএনপি সরকার নতুন করে আরও ৪৪ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে মোট ১ লাখ ৯৮ হাজার জনের নামে গেজেট প্রকাশ করে।

তালিকা: ২০০৯-২০২০

চারদলীয় জোট আমলে ৭২ হাজার ‘ভুয়া’ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় সন্নিবেশিত করা হয় বলে জাতীয় সংসদে অভিযোগ তোলেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম।

এরপর ২০০৯ সালের ১৩ মে তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

তাজুল ইসলামও ডেপুটি কমিশনার ও ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে তালিকা তৈরি করে ডিসি-ইউএনওদের কাছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ডিসি-ইউএনওদের নেতৃত্বের কমিটি দুই বছরেও তালিকা যাচাইয়ের কাজ শেষ করতে না পারায় মন্ত্রণালয় এবং এ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হস্তক্ষেপে প্রশ্নবিদ্ধ ৬২ হাজার জনের তালিকা এবং নতুন করে আরও ১ লাখ ৪৫ হাজার জনের নাম অন্তর্ভুক্তির তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে।

কিন্তু ওই সময়কার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে থাকায় এ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ আর এগোয়নি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০-২০১২ সালে আরও ১১ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে মোট দুই লাখ নয় হাজার জনের নাম তালিকাভুক্ত করে।

পাশাপাশি কয়েকজন সচিবের সঙ্গে কয়েকশ সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর গেজেট বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

পরে নতুন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে অনলাইনে আবেদন নেওয়া হয়।

বিএনপি সরকারের সময় নতুন করে তালিকাভুক্ত ৪৪ হাজারের বেশিরভাগ এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তালিকাভুক্ত ১১ হাজারের অর্ধেকই ‘ভুয়া’ বলে সনাক্ত করা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বেশ কয়েক বছরজুড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি চললেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ নানা কারণে আর শেষ করা যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চলতি মাসেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করব।

“আরও ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার গেটেজ যাচাইয়ের কাজ বাকি রয়েছে, এটা শেষ হলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বলা যাবে। তবে কোনোভাবেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি হবে না।”