মহামারীতে নির্মম বাস্তব দেখছেন কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা

পরিবার নিয়ে নিজের গড়া কিন্ডারগার্টেনে উঠেছেন মিজানুর রহমান। এক সময় এটি ছিল তার আয়ের উৎস; মহামারীকালে আয় হারিয়ে দায়ে পড়ে এখন এটি হয়েছে তার আশ্রয়স্থল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2020, 06:02 PM
Updated : 2 Dec 2020, 06:23 PM

শিশুদের জন্য মিজানুর রহমানের স্কুলটি রাজধানী ঢাকার পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডে। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর থেকে কিন্ডারগার্টেন বন্ধ, তাই তার আয়ও নেই। অর্থ সঙ্কটে বাসা ভাড়া দিতে কষ্ট হওয়ায় স্কুলটিতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে উঠে ছেড়ে দিয়েছেন বাসাটি।

ভিন্ন চিত্র নয় দেশের অন্য স্থানেও। ঢাকা থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরের মেহেরপুরের বড়বাজার বেড়পাড়ার শাফিউর রহমানের সুরুজের গল্পটিও একই রকম।

রোজ ডেল নামে একটি কিন্ডারগার্টেন চালাতেন তিনি। মহামারীর মধ্যে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষক থেকে এখন মুদি দোকানে বিস্কুট সরবরাহকারী বনে গেছেন তিনি।

আর ভবন ভাড়ার টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ঢাকার পূর্ব ধোলাইপাড়ের হলি হার্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটি বন্ধ করে দিয়ে শরীয়তপুরে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক হৃদয় ছৈয়াল।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সঙ্কটে পড়ে মিজানুর, শাফিউর ও হৃদয়ের মতো নির্মম অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছেন দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা।

সংশ্লিষ্টদের হিসাবে, বাংলাদেশে ৪০ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেনে ১০ লাখের মতো শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন।

অন্যসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত ১৭ মার্চ থেকে কিন্ডারগার্টেনগুলোও বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।

কওমি মাদ্রাসা বাদে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগামী ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা আছে। ১৯ ডিসেম্বরের পর কিন্ডারগার্টেনগুলো খুলে না দিলে অর্ধেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে বলে এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ধারণা করছেন।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সারা দেশে ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। মহামারীর মধ্যে বেশিরভাগের অবস্থাই বেশ করুণ।

“বিদ্যালয়ের ভাড়া শোধ করতে পারছি না, আমরা মানবেতন জীবনযাপন করছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে, এখন অনেকেই স্কুল বিক্রির চেষ্টা করছে, অনেকে অন্য পেশায় চলে গেছে।

“কেউ কেউ ভ্যান-অটো চালাচ্ছে, কেউ ফল বিক্রি করছে, কেউ মুদি দোকান দিয়েছে, কেউ কাপড় বিক্রি করছে। বিকল্প ওয়েতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।”

মিজানুরের কিন্ডারগার্টেনে এক হাজার ৩৫০ জন শিক্ষার্থী ছিল।

তিনি বলেন, “এখন যোগাযোগ করলে ৩৫০ জনের খোঁজ পাই, বাকিদের খোঁজ নাই। অ্যাসাইনমেন্টও নিচ্ছে না, বেতনও দিচ্ছে না। আবার যারা আসছেন তাদের অনেকেই বেতন দিতে পারছেন না।”

এই সঙ্কটকালে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে।

মিজানুর বলেন, “আমরা পাঁচ মাসের বেতন ছাড় দিয়ে হলেও প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে চাইছি। কিন্তু তা আদৌ সম্ভব হবে কি না, বুঝতে পারছি না।”

তার দাবি, তার সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ১০ হাজার কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে শতাধিক বন্ধ হয়ে গেছে। ডিসেম্বর মাস পার করে জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে না পারলে বন্ধ হবে আরও অনেকগুলো।

“বছরের শুরুতে যদি ছাত্র ভর্তি করাতে না পারি তাহলে তো আমাদের কিছুই থাকবে না। ২০২১ সালে আমাদের মনে করতে হবে নতুন স্কুল করলাম,” বলেন তিনি।

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের এই ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষ স্কুল চালাতে না পেরে বিক্রির নোটিস ঝুলিয়েছিল গত জুলাই মাসে, তবে এক ব্যক্তির সহায়তায় আপাতত টিকে রয়েছে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

কিন্ডারগার্টেনগুলো সরকারের কোনো সহায়তা ছাড়াই চলছে। তবে মহামারীর মধ্যেও সরকারের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি তারা।

মিজানুর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

“আমাদের যদি স্বল্প সুদে ব্যাংক লোনও দিত, তাহলে বাড়ি ভাড়া দিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারতাম।”

আরেক সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলছেন, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেড় হাজার কিন্ডারগার্টেন ইতেমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ““১৯ ডিসেম্বরের পর এসব প্রতিষ্ঠান খুলে না দিলে ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেনের অর্ধেকই বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার অনুমতি পাওয়া গেলে বলা যাবে প্রকৃতপক্ষে কতটি প্রতিষ্ঠান খুলবে।”

৯৯ শতাংশ কিন্ডারগার্টেন ভাড়া বাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে জানিয়ে ইকবাল বাহার বলেন, বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় অনেক বাড়ির মালিকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ঝামেলা হচ্ছে। এনিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে।

“আমরা সরকারের কাছ থেকে সহায়তা দাবি জানিয়েছি, বিভিন্ন সময় স্মারকলিপি দিয়েছি। সরকারের এমন কোনো কর্তাব্যক্তি নেই যে যার সাথে দেখা করিনি, কিন্তু কেউ কোনো সহযোগিতা করেননি।

“সরকার যদি সহযোগিতা না করে তবে অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। এরমধ্যেই অনেক শিক্ষক পেশা পরিবর্তন করেছেন, যা দেশের জন্য অকল্যাণকর, অসম্মানজনক।”

শিক্ষক নেতা বাহার বলেন, “আমরা তো কারও কাছে হাতও পাততে পারি না। গত নয় মাসে আমাদের এক পয়সা আয় নেই। আমরা ব্যথিত, কষ্টে আছে।

“আমাদের প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক, তাহলে আমরা বাঁচব। ১৯ ডিসেম্বরের পর প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি না দিলে তো আমরা ছাত্র ভর্তি করতে পারব না।”

কিন্ডারগার্টেন সমমান জাতীয় রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর কবির রানা জানান, তাদের জরিপ অনুযায়ী সারা দেশে ৬ হাজারের মতো কিন্ডারগার্টেন বন্ধের পথে বা বন্ধ হয়ে গেছে।

“এসব প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ বেতন নেওয়া হয় ৬০০ টাকা। আর তিন হাজার টাকার উপরে কোনো ভর্তি ফি নেই। আমাদের ঘর ভাড়া দিতে হয়, শিক্ষকদের বেতন দিতে হয়। ভর্তির সময় একটা বড় টাকা পাওয়া যায়। মূলত সেই টাকা দিয়েই সারা বছর চলতে হয়। জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে না পারলে তিন ভাগের দুই ভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।”

অনেকে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে বিদ্যালয়ের ভাড়া দিচ্ছেন বলে জানান জাহাঙ্গীর।

“কিন্তু এভাবে আর কতদিন? অনেকেই বলে থাকেন আমরা ব্যবসা করছি, কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখেন, আমরা কত কষ্টে আছি। এমন কোনো স্কুল নেই যে করোনার মধ্যে দুই, চার, দশ লাখ টাকা ঋণ হয়নি। জানুয়ারিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে না পারলে বেশিরভাগই টিকে থাকতে পারবে না।”

রামপুরার ওয়াপদা রোডের মেমোরী প্রিপারেটরি স্কুলের পরিচালক মিজানুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুটি ফ্লোর নিয়ে স্কুলের কার্যাক্রম চালাতেন তিনি। স্কুল বন্ধের পর ভাড়া অনেক বাকি পড়ে যায়, সব আয় বন্ধ হয়ে যায়।

“খরচ কমাতে এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে স্কুলেই উঠেছি, এখানেই থাকছি। একটু কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কোনোমতেই স্কুলটি বন্ধ করতে চাই না।”

মেহেরপুরের রোজ ডেল কিন্ডারগার্টেনের সুরুজ জানান, তার প্রতিষ্ঠানে ১৮টি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চালত। ৩৫৩ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন ১৬ জন শিক্ষক।

“খুবই ভালো চলছিল সবকিছু। এখন বেঞ্চগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘরের মালিক বার বার ভাড়ার তাগাদা দেওয়ায় একটি রুমে সব জিনিসপত্র রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিয়েছি।”

কীভাবে চলছে- প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখন দোকানে দোকানে বেকারির বিস্কুট স্পাপ্লাই দিই। কী আর করা, কিছু একটা করে তো চলতে হবে।”

কিন্ডারগার্টেন খুলে দেওয়ার দাবিতে যশোরের বেনাপোলে মানবন্ধন (ফাইল ছবি)

পূর্ব ধোলাইপাড়ের হলি হার্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল গুটিয়ে শরীয়তপুর চলে যাওয়া হৃদয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবন ভাড়ার ৫০ হাজার টাকা বাকি পড়ে গিয়েছিল। বাড়ির মালিক ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেল। টাকা তো দিতে পারিনি, স্কুলের সব আসবাবপত্র রেখে এসেছি। বাড়ির মালিককে অনুরোধ করেছি এগুলো বিক্রি করে ভাড়ার টাকা তুলতে, তিনি রাজি হওয়ায় স্কুল বন্ধ করে গ্রামে চলে এসেছি।”

মোহাম্মদপুরের ফুঁলকুড়ি কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক তকবীর আহমেদ কোভিড-১৯ সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠান বিক্রির নোটিস দিয়েছিলেন।

তিনি বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বস্তি এলাকায় আমাদের স্কুল, এখানে বেশিরভাগই গরিব ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। করোনার সময় সব কিছুই বন্ধ। এক পর্যায়ে কোনো বেতন পাচ্ছিলাম না, স্কুলের ভাড়া, শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছিলাম না, একের পর এক বন্ধের নোটিস আসছিল, আমি দিকহারা হয়ে গিয়েছিলাম, ১৭ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান চালাই, এখন ঋণের দায়ে পালাতে হবে, তাই বিদ্যালয় বিক্রির নোটিস দিয়েছিলাম।”

বিদ্যালয় বিক্রির নোটিস দিলেও কেনার মতো কেউ আসেনি বলে জানান তকবীর।

“বিভিন্ন গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় একজন ব্যক্তি ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ভাড়া চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন, ফলে বিক্রির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি।”

কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনগুলোর তথ্যানুযায়ী, সাভারের বাইপাইলের সৃজন সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রামপুরার হলি ভিশন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাভারের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ছাড়াও ঢাকার মাটিকাটার আইডিয়াল পাবলিক স্কুল এবং ব্লু বার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল মহামারীর মধ্যে বিক্রির নোটিস দিয়েছিল।

এছাড়া সংকটে পড়ে কিন্ডারগার্টেনের অনেক শিক্ষক পেশা পরিবর্তন করেছেন। ভাড়া কমানোর জন্য বিদ্যালয় ভবনের একটি অংশ ভাড়া দিয়েছেন অনেক প্রতিষ্ঠান।

এসব বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা শুনিয়েছেন তিনি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেসব কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি।

“কতটি কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়েছে, তা জানতে শিক্ষা কর্মকর্তাদের জরিপ চালাতে বলেছি। সেসব প্রতিষ্ঠানে কত সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত, সেই তথ্যও সংগ্রহ করতে বলেছি। কারণ এরা তো কোথাও না কোথাও ভর্তি হবে, তখন তাদের সরকারের পক্ষ থেকে বই দিতে হবে।”

তবে সঙ্কটে থাকা কিন্ডারগার্টেনগুলোর জন্য কোনো সহায়তার কথা জানা যায়নি শিক্ষার এই কর্মকর্তার কাছে।