নির্দেশনায় কাটেনি ‘টিউশন ফি’ জটিলতা

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে টিউশন ফি পরিশোধ করা নিয়ে সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও জটিলতা কাটেনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2020, 06:41 PM
Updated : 1 Dec 2020, 06:42 PM

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় অনেক অভিভাবক এখনও টিউশন ফি পরিশোধ করতে চাইছেন না।

অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সবার টিউশন ফি না পাওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনসহ প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সরকারি-বেসরকারি স্কুল ও কলেজগুলো কোন কোন খাতে ফি আদায় করতে পারবে সে বিষয়ে পৃথক তিনটি নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

সরকারের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি পরিশোধের কথা বলা হলেও মহামারীর মধ্যে যেসব অভিভাবকের আয় একেবারে কমে গেছে তাদের বিষয়টি ‘মানবিকভাবে’ বিবেচনা করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে।

সেই নির্দেশনার কথা তুলে ধরে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যন্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হামিদা আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাউশির নির্দেশনা নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে, আমরা আমাদের আপত্তির কথা তাদের জানিয়েছি।

“আমরা শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময় অভিভাবকদের কাছ থেকে কিছু টাকা নিই। ওই টাকা না পেলে আমরা তো স্কুল চালাতে পারব না। আমরা চাই, আমাদের যেন আরেকটু ছাড় দেওয়া হয়। তাই নির্দেশনা রিভিউ করতে বলেছি।”

টিউশন ফি পরিশোধ করা নিয়ে এখনও ঝামেলা কাটেনি জানিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, অনেক অভিভাবক টিউশন ফি-তে ছাড় চাইছেন। তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ‘সাধ্য’ অনুযায়ী সেই ছাড়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ফাইল ছবি

ন্যাশনাল বাংলা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের হিসাবরক্ষক মো. লিয়াকত হোসেন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, টিউশন ফি পরিশোধ করা নিয়ে সরকার নির্দেশনা দিলেও অভিভাবকদের অনেকে তা দিচ্ছেন না। ফলে প্রতিষ্ঠানের খরচ যোগাতে পারছেন না তারা।

“আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ভাড়া করা ভবনে চলে, চার লাখ টাকা ভাড়া বাকি, বিদ্যুৎ বিলও পরিশোধ করা হয়নি। আমাদের চার মাসের বেতন বকেয়া পড়ে আছে। প্রতিষ্ঠানের মোট বকেয়া ২০ লাখ টাকা।”

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে মাসুদ রানা জানান, তার মেয়ে ঢাকার মাতুয়াইলে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ে।

“বাসায় বসেই পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলে এর আগে একসঙ্গে দুই মাসের বেতন নিয়েছে তারা। তবে বেশ কয়েক মাস ধরে আর স্কুলের বেতন দিচ্ছি না “

এর পেছনে নিজের যুক্তি তুলে ধরে এই অভিভাবক বলেন, “পড়াশোনা তো কিছুই করাচ্ছে না, তাহলে বেতন দেব কেন?”

টিউশন ফি নিয়ে সরকার নির্দেশনা জারির পর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে কি না- সেই প্রশ্ন ছিল উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. তৌহিদুর রহমানের কাছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এখনও অনেক অভিভাবক টিউশন ফি দিচ্ছেন না। অনেকে টিউশন ফি-তে ছাড় চেয়ে আবেদন করছেন।

মাউশির নির্দেশনা প্রসঙ্গে এই অধ্যক্ষ বলেন, “সরকারের নির্দেশনায় দুই দিকেই ব্যালেন্স রাখা হয়েছে। ফলে আমরাও মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে যতটুকু করার চেষ্টা করছি।

“তবে এখনও অনেক শিক্ষার্থীর ১০/১১ মাসের বেতন বাকি। আমরা তো অর্থ সঙ্কটে পড়ে গেছি। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের চার মাসের বেতন বাকি।”

স্কুল কর্তৃপক্ষের মত অভিভাবকদের একটি সংগঠনও মাউশির নির্দেশনা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে না পারার কথা বলেছে। 

‘বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্যারেন্টস ফোরাম’ এর আহ্ববায়ক এ কে এম আশরাফুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সার্কুলার ধোঁয়াশা তৈরি করেছে, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।

“এখন স্কুলগুলো অতি উৎসাহী হয়ে টাকা (টিউশন ফি) আদায় করার জন্য অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্টসহ নানান কথা বলে চাপ দিচ্ছে, টিউশন ফি-তে আর ছাড় দিচ্ছে না। এতে করে অভিভাবককের পেরেশানি বেড়ে গেছে।”

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিভাবককের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে জানিয়ে আশরাফ বলেন, “সেখানে করোনাকালীন টিউশন ফি-তে ছাড়া দেওয়া, টিউশন ফি বকেয়া থাকায় অনলাইন ক্লাস থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া বন্ধ করা, টিউশন ফি পরিশোধে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তির সুবিধা দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হবে।”

করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে টিউশন ফি ৫০ শতাংশ কমানোর দাবিতে মানববন্ধনে একজন অভিভাবক। ফাইল ছবি

ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেদর সংগঠন ‘অভিভাবক ঐক্য ফোরাম’ এর সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, টিউশন ফি নিয়ে যে সার্কুলার দেওয়া হয়েছে তা সংশোধন করে টিউশন ফি মওকুফের ব্যবস্থা চান তারা।

“কারণ মহামারীর মধ্যে অনেক অভিভাবকের আয় নেই, বেশিরভাগেরই আয় কমে গেছে। তাই টিউশন ফি মওকুফ করতে হবে।”

টিউশন ফি মওকুফের পক্ষে যুক্তি দিয়ে দুলু বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন সরকার দিচ্ছে। অভিভাবকরা বেতন না দিলে আংশিক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সমস্যা হবে, এদের সরকারের প্রণোদনার আওতায় আনতে হবে।

“অনেক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে, তাই তারা বেতন আদায় না করলে ওইসব শিক্ষকের বেতন দিতে পারবে না। কিন্তু অনলাইনে পাঠদান তো খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। যেসব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে সেখানেও প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে না, তাহলে কেন তাদের বেতন দিতে হবে?”

এসব বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) মো. বেলাল হোসাইনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টিউশন ফি নিয়ে নির্দেশনা জারির পর এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে কেউ আমাদের কিছু বলেনি। এখন পর্যন্ত ওই নির্দেশনাগুলোই বহাল আছে।”