বাবুনগরীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকারী হেফাজতে ইসলামের নেতাদের হুঁশিয়ার করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2020, 02:24 PM
Updated : 1 Dec 2020, 06:47 PM

তিনি বলেছেন, “এই সমস্ত অর্বাচীন কথা, এই সমস্ত আস্ফালন বন্ধ করে দিন। না হয় বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ রাজপথেই এর জবাব দেবে। তার পরিণাম ভালো হবে না।”

বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান অবমাননার অভিযোগে হেফাজতের আমির জুনাইদ বাবুনগরী এবং যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের গ্রেপ্তার দাবিতে মঙ্গলবার ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে মানববন্ধনে একথা বলেন তিনি।

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে এই কর্মসূচিতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের ৬০টি সংগঠন অংশ নেয়। এর বাইরেও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা সংহতি জানান।

মুজিববর্ষে ঢাকার ধোলাইড়পাড়ে বঙ্গবন্ধুর যে ভাস্কর্য সরকার স্থাপন করছে, তার বিরোধিতায় নেমেছে হেফাজতসহ ইসলামী কয়েকটি দল।

এদের মধ্যে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির সৈয়দ ফয়জুল করিম বেশ সরব।

গত ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী যে কোনো দল ভাস্কর্য বসালে তা ‘টেনে হিঁচড়ে’ ফেলে দেওয়া হবে।

তাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে আয়োজিত দীর্ঘ মানববন্ধনে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে সংহতি জানাতে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক।

তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, ইসলামকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল, আমি জানি না, তাদের প্রেতাত্মারাই আবার এই ধরনের আস্ফালন করছে কি না?

“সরকারের উচিৎ অবিলম্বে তাদের কার্যক্রম এবং এই যে সংবিধানবিরোধী বক্তব্য সেগুলো খতিয়ে দেখে আইনের শাসন কায়েমের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এটা কি ব্যক্তিগত খামখেয়ালিপূর্ণ উক্তি, নাকি সুপরিকল্পিত উক্তি, ভালোভাবে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকারীদের গ্রেপ্তার দাবিতে মঙ্গলবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধনে অংশ নেয় বিভিন্ন সংগঠন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিসসহ নানা ধর্মীয় সংগঠন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন মানববন্ধনে অভিযোগ করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।

সেই সূত্র ধরে মোজাম্মেল হক বলেন, “নব্বই ভাগ মুসলমান যে দেশে, সে দেশে কিছু লোক ধর্ম ব্যবসায়ী হয়ে, ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেন, অপব্যাখ্যা করবেন ইসলামের.. আর ইসলাম প্রিয় মানুষ নীরবে সেটা দেখবে, কিছু বলবে না, এটা তো হতে পারে না।

“ধর্ম কারও কাছে লিজ দেওয়া হয় নাই। কোনো গোষ্ঠীর কাছে কেউ ধর্মকে লিজ দেয় নাই। ধর্মের রক্ষক আপনারা কয়েকজন নন। এই দেশের মানুষ যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে, তারাই ধর্মের রক্ষক।”

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য রাখলেও হেফাজতের নেতাদের এখনও সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে কিছু বলা হয়নি, যাকে তাদের ‘সৌভাগ্য’ বলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী।

“বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী চলছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ধৃষ্টতা! সুনির্দিষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলার পরেও এখনও কেউ কিছু বলে নাই। আমি মনে করি, এটাই আপনাদের সৌভাগ্য। আর এই ধৃষ্টতা দেখাবেন না। দেখালে পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

হেফাজত নেতাদের বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান মোজোম্মেল হক।

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে মঙ্গলবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ আছে। কোনোভাবেই আমরা এই দেশকে মৌলবাদীদের আগ্রাসনে নিতে দেব না।”

হেফাজত নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনাদের এই চোখ রাঙানি বন্ধ করেন। আমরা শান্ত আছি। শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের আপনারা ভুল বোঝাবেন না।”

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তাপস।

“আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, অবিলম্বে আইনের আওতায় এসকল দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”

শ্রমিক নেতা, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান সংহতি জানিয়ে বলেন, “আমরা কিন্তু ঘুমিয়ে নেই। বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ গড়ে তুলব।”

যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে এলেও তিনি বক্তব্য দেননি। সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকারীদের গ্রেপ্তার দাবিতে মঙ্গলবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে আয়োজিত মানববন্ধন শেষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শিখা চিরন্তনের পথে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সমাবেশের শুরুতে মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণাপত্র পাঠ করেন রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশের আহ্বায়ক সাংবাদিক আবেদ খান।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার হুমকি দিয়ে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট এসব স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী অপশক্তি বাংলাদেশকে জিয়াউল হকের পাকিস্তান ও মোল্লা উমরের আফগানিস্তানের মতো তালেবানি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে চায়।

“ওয়াজের নামে বড় বড় সমাবেশ করে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মত, ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসী, নারী সমাজ সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার করছে। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব সন্ত্রাসী জিহাদীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।”

পরে তিনি সংক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সাত দফা দাবিও পড়ে শোনান।

সাত দফা

>> জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের সংবিধান অবমাননাকারী মামুনুল-বাবুনগরীকে গ্রেপ্তার করতে হবে।

>> বাংলাদেশে জামায়াত-হেফাজতের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

>> বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল ও খুৎবার নামে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মত, নারী ও ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ প্রচারকারী ও হুমকি প্রদানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

>> সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা ও জাতির পিতার জীবন জীবন ও দর্শন পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

>> মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা অস্বীকার যারা করবে, তাদের শাস্তির জন্য কার্যকর আইন করতে হবে। পাশাপাশি ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে।

>> অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষানীতি, নারী নীতি, সংস্কৃতি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

>> সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশ, জাতি, সংবিধান ও জাতির পিতার বিরুদ্ধে বিষোদগারকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।