বাবুনগরী, মামুনুলদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনে ৬০ সংগঠন

বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান অবমাননার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী এবং যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের গ্রেপ্তার দাবিতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে মানববন্ধনে অংশ নিয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের ৬০টি সংগঠন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2020, 09:48 AM
Updated : 1 Dec 2020, 11:47 AM

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটা থেকে মৎস ভবন থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ঢাকা ক্লাব, শাহবাগ মোড় ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছবির হাট পর্যন্ত এই মানববন্ধন কর্মসূচি শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক, যুবলীগ সভাপতি শেখ ফজলে শামস, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সাংবাদিক আবেদ খান, ইতিহাসের অধ্যাপক, গবেষক মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তসহ আরও অনেকে কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন।

এই কর্মসূচির মূল দাবি- অবিলম্বে হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তার এবং জামায়াত-হেফাজতের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।

সম্প্রতি রাজধানীর ধোলাইরপাড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে সে কাজ অবিলম্বে বন্ধের দাবি তুলেছেন হেফাজত নেতা মামুনুল হক।

আর গত ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী বলেছেন, যে কোনো দল ভাস্কর্য বসালে তা ‘টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেওয়া হবে’।

মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, “বক্তব্য (ভাস্কর্যবিরোধী) প্রত্যাহার করতে হবে। না হলে বাংলার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ জবাব দেবে। পরিনাম ভালো হবে না। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেওয়ার পরেও এখনও তাদের নিয়ে কিছু বলা হয়নি। এটাই আপনাদের সৌভাগ্য। দৃষ্টান্তমূলক পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “আমরা মনে করি, ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। কাজেই যারা বাংলাদেশে ভাস্কর্যের সাথে ধর্মের সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করছে, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করার সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”

বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, “সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটছে বাংলাদেশে… সবচাইতে এলার্মিং ঘটনা… সেটি হচ্ছে, জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলে নদীতে ছুঁড়ে ফেলার মতো ধৃষ্টতা তারা দেখিয়েছে। তারা কোনো অবস্থাতেই ভাস্কর্য করতে দেবে না বলেছে।

“কারা বলছে? তারা কারা ? তারা হচ্ছে একাত্তরের পরাজিত সৈনিক, একাত্তরের পরাজিত শত্রু, তাদেরই উত্তরসূরি, একেবারেই তাদের প্রতীকী রূপ। মামুনুল হক থেকে শুরু করে চরমোনাই পীরের যে ছেলে এখন রিট করছে, প্রতিটা লোক…বাবুনগরী… প্রতিটা লোকের সূত্র হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করা।”

সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এখন প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ।

একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসরদের যথোপযুক্ত শাস্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অবস্থান খুব পরিষ্কার। একাত্তরে তাদের অনেককেই পরাজিত করলেও যথাযোগ্য শাস্তি দেইনি। তাদের যে শাস্তি দেওয়া উচিৎ ছিল, সেটা দেওয়া হয়নি …সেটার নানা কারণ আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডই মূল কারণ, যেটার মধ্য থেকে তাদের উত্থান। আজকে যারা নতুন করে বাংলাদেশের অস্তিতে হুমকি দিচ্ছে, যারা আজকে মসজিদের ভেতরে মানুষ পুড়িয়ে মারছে, তাদের যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিতে সরকারকে বাধ্য করব।”

মৌলবাদের আস্ফালন রুখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব শক্তিকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব।

তিনি বলেন,“তারা এত বছর ধরে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে।  এটা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, তারা বাংলাদেশকে একটা তালেবানি রাষ্ট্র করতে চায়। যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, সেই বাংলাদেশ কখনও পাকিস্তানি, আফগানিস্তানি বা তালেবানি রাষ্ট্র হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর এই ধরণের বক্তব্যের বিরুদ্ধে একত্রিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।”

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক মহল দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যে চেষ্টাটি করছে, এটি শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।”

বাংলাদেশ কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, “আজকে যে অন্ধ মৌলবাদী শক্তি ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে, তাদের পুলিশি ব্যবস্থায় শাস্তি দিলেই হবে না। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সচেতন করে তুলতে হবে যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো অক্ষয় থাকে।”

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহ সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম বলেন, “আজ আমরা মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীগুলোর যে ধৃষ্টতা দেখছি, তা একদিনে তৈরি হয়নি। একাত্তরের পরাজিত এই অপশক্তিগুলোর প্রতি বারবার নতজানু নীতি প্রদর্শন করেছে বর্তমান সরকার।

“মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যা, পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ, সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণসহ নানাবিধ রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীন কর্মকাণ্ডের ফসলই হল জাতির পিতাকে নিয়ে তাদের আজকের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ। উদীচীর দাবি, অবিলম্বে সংবিধান থেকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বাতিল করে বাহাত্তরের অসাম্প্রদায়িক সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। মৌলবাদের জুজুর ভয়ে রাষ্ট্রের প্রশ্রয়-আপসের অবসান ঘটাতে হবে।”

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ছাড়াও এ কর্মসূচিতে অংশ নেয় সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাসোসিয়েশন, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, প্রজন্ম ’৭১, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ, ইতিহাস সম্মিলনী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গবেষণা সংসদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), জাতীয় যুব জোট, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ সংহতি পরিষদ,. বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ), বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরাম, গৌরব ’৭১, অপরাজেয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, কর্মজীবী নারী, জাতীয় নারী জোট, নারী মুক্তি সংসদ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএসএ (বাংলাদেশ চাপ্টার), জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চা, সেক্যুলার ইউনিটি বাংলাদেশ, ইউথ ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, ঘাসফুল শিশু কিশোর সংগঠন, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশ।