ঢাকার মিরপুরে কথা হল পঞ্চাশোর্ধ্ব রিকশাচালক সেলিমের সঙ্গে; ফুটবল ভালোবাসেন তিনি, আর এই ভালোবাসার কারণ মারাদোনা।
১৯৮৬ সালে টেলিভিশনে মারাদোনার খেলা প্রথম দেখেছিলেন তিনি।
“তার খেলা এখনও চোখে ভাসে। ওর কারণেই ফুটবল দেহি।”
আর্জেন্টিনা থেকে উঠে এসে বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চ মাতিয়ে তোলা মারাদোনা ৬০ বছর বয়সে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে বুধবার চিরবিদায় নিয়েছেন।
এই ফুটবল কিংবদন্তির মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত গোটা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশও।
শোকে এই চিত্র কেমন, তা উঠে এসেছে গণমাধ্যমকর্মী গাজী নাসিরউদ্দিন আহমেদের ফেইসবুক স্ট্যাটাসে- “গ্লোবাল ভিলেজ হল আজকের রাতটা। পৃথিবীর সব মানুষ একই বেদনায় আক্রান্ত। আমি হলফ করে বলতে পারি, পৃথিবীতে এমন মৃত্যু আর আসেনি।”
বিশ্ব ফুটবলে আর্জেন্টিনার যে সমর্থক গোষ্ঠী বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, তার কারণ এই মারদোনাই।
সাংবাদিক ফাল্গুনী রশীদ ফেইসবুকে লিখেছেন, “বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ম্যারাডোনার জন্য ফুটবল দেখে.... তা ম্যারাডোনা মাঠে কিংবা পৃথিবীতে থাকুক আর নাই থাকুক।”
১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে যে সৌরভ ছড়িয়েছিলেন মারাদোনা, আটলান্টিক পেরিয়ে উন্মাদনার সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাংলাদেশে। তার ফুটবল জাদু বিশ্বের কোটি অনুরাগীর মতো বাংলাদেশেও বুঁদ করে রেখেছিল অসংখ্য মানুষকে।
তাই শোক শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় কিংবদন্তির মহানায়ককে স্মরণ করছেন সব শ্রেণির ভক্ত-অনুরাগীরা।
ঢাকার পল্লবীর বাসিন্দা ঠিকাদার আজহার উদ্দিনের বেড়ে ওঠার সময় মারাদোনা ছিলেন বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় নাম।
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “তার খেলা যে মুগ্ধতা নিয়ে দেখতাম, সেটা এরপর আর কারও খেলায় দেখিনি। তার নামে অনেক সমালোচনা আছে, বিতর্ক আছে; কিন্তু আমরা যারা তার খেলা দেখেছি, তাদের কাছে মারাদোনা মারাদোনাই।
“আমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে তার খেলা দেখতে পেরেছি। আফসোস, মহাতারকারাও শুধু বিদায়ই নিচ্ছে, আসছে খুবই কম।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর সদ্য সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক শাকিল আহমেদ তানভীর বলেন, “ফুটবল নিয়ে কথা বলতে গেলে অনায়াসেই মারাদোনার নাম চলে আসে। তার প্রতিভার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আজকে ক্যাম্পাস খোলা থাকলে অনেকে শোক সভার আয়োজন করত।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী তাসনিম জাহান অর্পিতা বলেন, “ফুটবল আর মারাদোনা সমার্থক শব্দ। ছোট বেলা থেকেই ফুটবল নিয়ে কথা উঠলে মারাদোনার বিস্ময়কর সাফল্যের কথা শুনতাম। তার প্রস্থান বিশ্বাস করতে পারছি না। তিনি আছেন, থাকবেন; আমাদের মতো ভক্তের হৃদয়ে।”
ফুটবলে সর্বকালের সেরাদের সেরা ভাবা হয় মারাদোনাকে। কেন- তার ব্যাখ্যায় এক সময়ের ক্রীড়া সাংবাদিক ব্লগার অমি রহমান পিয়াল ফেইসবুকে লিখেছেন, “৮৬র মতো এত তারকা ফুটবলার কোনো বিশ্বকাপে ছিল না! মিশেল প্লাতিনি, এনজো ফ্রান্সেসকোলি, এমিলিও বুত্রাগুয়েনো, বেলানভ, শিফো, গ্যারি লিনেকার, বনিয়েক, সক্রেটিস, কারেকা, রুমেনিগে, সানচেজ, লাউড্রপ- বলে শেষ করা যাবে না। এদের সঙ্গে লড়ে, এদের ভিড়ে নিজেকে আলাদা করে চিনিয়েছিলেন ম্যারাডোনা!
“মারাদোনা প্রসঙ্গে ‘হাউ গুড ওয়াজ হি’ প্রশ্ন করে কেউ নিজেকে বিব্রত করে না। ‘বেটার’ বিশেষণও তার জন্য প্রায়োগিক নয়। হি ওয়াজ দ্য বেস্ট- এটাই সত্য।”
মারাদোনার কারণেই যে ফুটবলের ভক্ত হয়ে ওঠেছেন, সে কথা জানালেন তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “আমার জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল দেখি ১৯৮৬ সালে। আমি সেই শৈশব থেকেই আর্জেন্টিনা আর ম্যারাডোনার ভক্ত। ফুটবলের এই কিংবদন্তির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবরিনা হোসেন বলেন, “মারাদোনা যখন খেলতেন তখন আমার জন্মই হয়নি। কিন্তু আমি যে আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করি, ফুটবল ভালোবাসি; সেটা মারাদোনার কারণেই। এখনো ইউটিউবে তার খেলাগুলো প্রায়ই দেখি।
“কিংবদন্তির মৃত্যু নেই। কর্মই তাদের জীবন। মারাদোনার কর্ম বেঁচে থাকবে, তিনিও বেঁচে থাকবেন আমাদের চিরপরিচিত একজন হয়ে।”
বাংলাদেশের ফুটবল মানেই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের দ্বৈরথ। কিন্তু ফুটবলেরই মুখ হয়ে ওঠা মারাদোনার মৃত্যু সেই বিভেদ ছোঁয়নি।
ব্রাজিলকে সমর্থন করলেও ইন্টারনেটে মারাদোনার খেলা দেখে তার ভক্ত হয়ে যান মিরপুর ১০ নম্বরের ইউনিয়ন ব্যাংকের কর্মচারী আল-আমিন।
“অনেকের খেলাই ভালো লাগে, কিন্তু মারাদোনার মতো কাউকে দেখিনি। ছোট প্যান্ট পরে যে দৌড় দিত বল নিয়ে, বল কারও পায়ের এতটা কথা শোনে! সে দৃশ্য ভুলতে পারব না। মৃত্যুর খবরটা যখন শুনলাম, মেনে নিতে পারছিলাম না। খুব খারাপ লেগেছে।”
ব্রাজিলের আরেক সমর্থক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শায়মা তন্বী বলেন, “আমি মারাদোনাকে ভালোবাসি, কারণ তিনি খেলাটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শৈল্পিক উচ্চতায়।
“এমন উচ্চতায় খুব কম লোকই পৌঁছাতে পারে। চলে গিয়েও যারা যুগ যুগ বেঁচে থাকেন, তিনি তেমনই একজন।”
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাদমান রহমান ধ্রুব বলেন, “১৯৮৬ বিশ্বকাপের প্রায় ৮ বছর পর আমি পৃথিবীতে আসি। কিন্তু এই ফুটবল জাদুকরের ঐন্দ্রজালিক কর্মকান্ডের কাব্যকথা আমার ২৫ বছরের জীবনে একটুখানি ফিকে হতে দেখিনি।
“এই ছোটখাটো মানুষটা নিজে তো ফুটবল জগৎ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বটেই, সেই সাথে লাখো তরুণকে দেখিয়েছেন বড় ফুটবলার হবার স্বপ্ন।”
পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও মারাদোনা বেঁচে থাকবেন ভক্তদের হৃদয়ে।
মিরপুরের ব্যবসায়ী শাহাব উদ্দিন বলেন, “মারাদোনার মতো কিংবদন্তিরা সবসময় জীবন্ত থাকবেন। তাদের মত মহাতারকাদের মৃত্যু হয় না। মারাদোনার মতো মানুষ আর আসবে না। খেলার বাইরেও তার জগত ছিল। সেই কারণেই তিনি অমর হয়ে থাকবেন।”
মারাদোনার পায়ে যখন ফুটবল থাকত, তা মোহাবিষ্ট হয়ে দেখত সবাই। কিন্তু ফুটবলের বাইরে তার জীবন নিয়ে যেমন রয়েছে বিতর্ক, তেমনি তাতে অন্য অনুপ্রেরণাও খুঁজে পান অনেকে।
সেই প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু ফেইসবুকে লিখেছে, “ফুটবলার ম্যারাডোনা, কোচ ম্যারাডোনা, ফিদেলের বন্ধু ম্যারাডোনা, ক্ষ্যাপাটে পাগলা ম্যারাডোনা, চুরুট টানা-হাতে চে'র উল্কি আঁকা ম্যারাডোনা, হ্যান্ড অব গড এর মালিক ম্যারাডোনা, আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা- সর্বোপরি ফুটবলের ঈশ্বর ম্যারাডোনা আমার মহানায়ক।
“বিদায় কিংবদন্তী। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ঈর্ষা করবে কারণ আমরা ম্যারাডোনার সময়ে জন্মেছিলাম।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মুহতাসিম ফাহমিদ প্রত্যয় ফুটবলার মারাদোনার উদ্দাম জীবনযাপনের মধ্যে দেখেন প্রতিবাদী রূপ।
“তিনি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চিরকাল লড়ে যাওয়া এক কমরেড, সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। পৃথিবীর সামনে লাতিন আমেরিকার সংগ্রামের বরপুত্র তিনি, লাতিন কৃষ্টির সবচেয়ে বড় দূত। তার এই অকালপ্রয়াণে ফুটবলেরই ক্ষতি হলো না, গণমানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।”