সাভারের শ্যামলাপুর, কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুর ও ঘাটারচর অংশে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের তীর এবং প্লাবনভূমি দখল করে এই দুই প্রতিষ্ঠান গড়ছিলেন আসলামুল হক।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় ও আইন কানুনের ভিত্তিতে কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুর, ঘাটারচর এবং সাভারের শ্যামলাপুর মৌজায় বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদীর জমি, নদীর তীরভূমি, প্লাবনভূমিসহ মোট ৫৪ দশমিক ০১৭৮ একর জমিতে মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন কর্তৃক নির্মিত অবৈধ স্থাপনা অবিলম্বে উচ্ছেদ করবে।
সেই সাথে নদী, নদীর প্লাবন ভূমি জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করার সুপারিশ প্রদান করা হল। বিআইডব্লিটিএ ইতোপূর্বে যে উচ্ছেদ ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছিল তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গভাবে সুসম্পন্ন করার জন্য সুপারিশ করা হল।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থাপনা সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে কিংবা অবহেলা করলে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কালবিলম্ব না করেই উল্লেখিত সংস্থাসমূহের (বিআইডব্লিউটিএ, রাজউক, নদী কমিশন, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরসহ বেশ কিছু সরকরি সংস্থা) সমন্বয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবেন এবং অভিযানের যাবতীয় ব্যয়ভার আবেদনকারী (যৌথ জরিপের জন্য বিআইডব্লিটিএ কাছে আসলামুল হকের আবেদন) বা অভিযোগকারী বহন করতে বাধ্য থাকবেন।
কমিশনের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর যৌথ জরিপের পর গত ৯ নভেম্বর এ প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বা আগামী রোববার প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে। প্রতিবেদনে ১০ দফা সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।”
আরিশা অর্থনৈতিক জোন করতে ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অনুমোদনের পর শ্যামলাপুর মৌজার (তুরাগ নদের তীর সংলগ্ন) ৫১ দশমিক ০১২১ একর জমির ওপর এই বেসরকারি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। গত বছর ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্মাণ কাজের উদ্বোধনও করেন।
এ অবস্থায় বিআইডব্লিউটিএ গত ২৩ অগাস্ট আরিশা কর্তৃপক্ষকে নোটিস দিয়ে সাত দিনের মধ্যে নদীর জমি থেকে স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বলে। একই সঙ্গে ভরাট করা মাটি সরিয়ে ভূমি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে বলা হয়।
আরিশা অর্থনৈতিক জোন সাত দিনের মধ্যে কাজটি করতে ব্যর্থ হলে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ করবে। এই উচ্ছেদের খরচ আরিশাকে বহন করতে হবে।
এই নোটিস পাওয়ার পর গত ২৬ অগাস্ট এর জবাব দেয় আরিশা কর্তৃপক্ষ।
জবাবে তুরাগের জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি বিরোধপূর্ণ এলাকায় যৌথ জরিপ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ এ বিষয়ে কোনো জবাব না দিলে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন আসলামুল হক।
ওই রিটের শুনানির পর গত ২ সেপ্টেম্বর হাই কোর্ট ‘আরিশা অর্থনৈতিক জোন’র নির্মাণ কার্যক্রমে স্থিতাবস্থা এবং নির্মাণাধীন জোন উচ্ছেদে বিআইডব্লিউটিএ’র কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
এরপরই ঢাকার জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে বিআইডব্লিউটিএ, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংরাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান-স্পারসোর প্রতিনিধিদের নিয়ে জরিপ চালানো হয়।
জরিপে বুড়িগঙ্গা, তুরাগের ১২.৭৮৬৪ একর, তীরভূমি ও প্লাবনভূমির ৭.৯২১২ একর ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ড্যাপের আওতাভুক্ত জমিসহ মোট ৫৪ দশমিক ০১৭৮ একর জমিতে মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোনসহ বেশ কিছু বাণিজ্যিক অবৈধ স্থাপনার প্রমাণ মেলে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্য আসলামুল হক এমপির বিরোধপূর্ণ ভূমি নদীর তীরভূমির (ফরশোর) মধ্যে মধ্যে অবস্থিত। তাই আইনত তর্কিত জমিতে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা বা শ্রেণি পরিবর্তন করা আইনানুগ হয়নি। কিন্তু আসলামুল হক এমপির মালিকানাধীন মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন তা লংঘন করেছে।
এছাড়া বন্দর আইন-১৯০৮, বন্দর বিধি-১৯৬৬ অনুযায়ী নদী বন্দর সংরক্ষকের অনুমতি ছাড়া বন্দর এলাকায় বা সীমানায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রম গ্রহণের এখতিয়ার নেই। এ ধরনের কার্যক্রম বন্দর আইন-১৯০৮, বন্দর বিধি-১৯৬৬, অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদী ও নদীর তীরভূমি তথা নিম্নাঞ্চল ভরাট বা ক্ষতিগ্রস্ত করায় সর্বোপরি নদীর প্লাবন ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং প্রাকৃতিক জলাধার আইন, ২০০০ এর পরিপন্থি ও দণ্ডনীয় অপরাধ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপিত হলে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এমনকি নৌ-চলাচলের পথ ও সুযোগ আরও সঙ্কুচিত হবে।
তাই বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী রক্ষার স্বার্থে মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোনের নির্মাণ কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর তীরে স্থাপিত মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন নির্মাণ কার্যক্রমের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে লাল শ্রেণিভুক্ত করে ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়েছে।
এই কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যা ভবিষ্যতে আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন নির্মাণকে পরিবেশ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ এর সুস্পষ্ট লংঘন এবং ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বলা হয়েছে, নদীর জমি জেনেও অবস্থানগত, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন না করে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হয়নি; যা আইনের পরিপন্থি।
এমনকি তা বিআইডব্লিটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজউকের সাথে আলোচনা করে বা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে এ ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোনকে যেহেতু পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি তাই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকলেও জোনকে ছাড়পত্র দেওয়া পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ এর সুস্পষ্ট লংঘন।