ডাক্তার বলেছেন, সামনে শীতের দিনগুলোতে সাবধান থাকতে হবে, ঠাণ্ডা লাগানো চলবে না, দূরে থাকতে হবে ধুলোবালি থেকেও।
মিশুক রায়হানের মত যারা কোভিড-১৯ এ ভুগে সেরে উঠেছেন, কিংবা আগে থেকেই ফুসফুসের জটিলতা বা শ্বাসকষ্টের মত সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য এবার শীত আসছে বাড়তি সতর্কতার বার্তা নিয়ে।
প্রতিবছর শীতে ঢাকায় ধুলোর দূষণে যে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা করোনাভাইরাস প্রতিরোধের লড়াইকে কঠিন করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর বায়ু ফুসফুসকে কমজোরি করে দেয়। তার মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
তাছাড়া শীত মৌসুমে এমনিতেই ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ে, সেগুলোর উপসর্গ আবার কোভিড-১৯ এর মতই। ফলে ঠিকমত পরীক্ষা না হলে কোভিড-১৯ আরও বড় বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে।
বায়ুদূষণ কোন পর্যায়ে?
মহামারীর শুরুর দিকে লকডাউনে যানবাহন চলাচল আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে ধুলো কমে বায়ুমানে এসেছিল সীমিত স্বস্তি। কিন্তু শীতের শুরুতে শুষ্ক আবহাওয়ায় বায়ুদূষণ আবার উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে।
গত দুই সপ্তাহ ধরেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বায়ুমানের অবনতি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তা বিপজ্জনক সীমাও স্পর্শ করছে।
বাতাসের মান নির্ভর করে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে।
পিএম ২.৫, পিএম ১০ ছাড়াও সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও গ্রাউন্ড লেভেল ওজোনে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বিবেচনা করে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই তৈরি হয়। একিউআই নম্বর যত বাড়তে থাকে, বায়ুমান তত ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হয়।
একিউআই শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে সেই এলাকার বাতাসকে ভালো বলা যায়। ৫১-১০০ হলে বাতাসের মান মডারেট বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়।
একিউআই ১০১-১৫০ হলে সেই বাতাস স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের (শিশু, বৃদ্ধ, শ্বাসকষ্টের রোগী) জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং ১৫১-২০০ হলে তা সবার জন্যই অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয়। আর একিউআই ২০১-৩০০ হলে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ পেরিয়ে গেলে সেই বাতাসকে বিপদজনক ধরা হয়।
সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট-সিএএসই প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার ঢাকার গড় একিউআই ছিল ২৮৪। বাতাসের মান বিবেচনায় ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এই দিনে একিউআই উঠেছিল ২৯৪ পর্যন্ত। আর ঢাকার পাশের নারায়ণগঞ্জের বায়ুমানও ছিল ‘খুবই বিপদজনক পর্যায়ে’ (৩৫৩ একিউআই)।
আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার এর তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরের শেষ ১১ দিনের মধ্যে ৬ দিনই ঢাকার বাতাসের একিউআই ছিল একশর নিচে, অর্থাৎ সন্তোষজনক পর্যায়ে। তবে নভেম্বরের শুরুতেই ঢাকার বাতাসে ধুলা বাড়তে শুরু করে। মাসের প্রথম ১০ দিনই একিউআই ১৫০ এর উপরে ছিল, এর মধ্যে ৪ নভেম্বর উঠেছিল ২২৫ এ।
শহরের বায়ুমান সবচেয়ে খারাপ থাকে সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত। এই সময়ে ঢাকার বাতাসের মান অস্বাস্থ্যকর থেকে বিপদজনক পর্যায়ে ওঠানামা করতে দেখা যায়।
বায়ুর এই সূচকে খুব হেরফের না হওয়ায় নিয়মিতই রাতের দীর্ঘসময় ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ১ নম্বরে থাকছে।
সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নভেম্বরে একিউআই গড়ে ১৮০ থেকে ২০০ এর মধ্যে ওঠানামা করলেও সামনের সপ্তাহগুলোতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চে বায়ুমানটা বেশি খারাপ থাকে। বিশেষ করে ডিসেম্বরেই বেশি খারাপ হয়।”
তিনি জানান, শীতে বায়ুদূষণের উৎসগুলো কার্যকর থাকে। বাতাসের গতিবেগ কম থাকে বলে দূষিত বায়ুর স্তর সরতে সময় নেয়। বৃষ্টি হয় না বলে বাতাস পরিষ্কার হয় না।
আর এখানেই বিপদ দেখছেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা।
মহামারীতে ঝুঁকি কতটা?
বায়ুদূষণ যে মহামারী পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে, সে চিত্র ইতোমধ্যে উঠে এসেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায়।
তাতে দেখা গেছে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকনা- পিএম ২.৫ এর পরিমাণ এক মাইক্রোগ্রাম বাড়লেই করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার ৮ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।
পাশের দেশ ভারতেও করোনাভাইরাস মহামারীর সঙ্গে বায়ুদূষণ যুক্ত হলে মৃত্যু হার বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস এর পরিচালক রণদীপ গুলেরিয়া।
তার মতে, দূষণ বেড়ে গেলে বাতাসে করোনাভাইরাসের আয়ুও অনেকটা বাড়তে পারে, ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশে মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহর ঢাকায় ইতোমধ্যে সোয়া লাখের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, যা দেশের মোট সংক্রমণের এক-চতুর্থাংশের বেশি।
এই ভাইরোলজিস্ট বলছেন, বয়স্ক ও কো-মরবিডিটি যাদের রয়েছে, দূষণের এই সময়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।
“বায়ুদূষণে ফুসফুসে নানা ধরনে ক্ষতি হয়। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত থাকলে করোনাভাইরাস দ্রুত সেখানে বিস্তার লাভ করতে পারে। আবার ফুসফুস যদি আগে থেকেই দুর্বল থাকে, কোমরবিডিটি থাকে, তাহলে ভাইরাসটা অনেক বেশি ক্ষতি করে ফেলে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্যের মতে, দূষিত বাতাস ফুসফুসসহ শরীরের অন্যান্য অংশের যে ক্ষতি করে, তাতে মহামারীর মধ্যে ভুগতে হবে অনেক মানুষকে।
“বাতাসে অনেক ধুলাবালি থাকলে সেটা ফুসফুসের ক্ষতি করে। তখন ভাইরাসের বিস্তৃতি লাভ করতে সুবিধা হয়।”
আর এক্ষেত্রে নিদান বলতে সেই মাস্ক। ঢাকার মত শহরে করোনাভাইরাস না থাকলেও মাস্ক পরা উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল।
আর বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মির্জা মোহাম্মদ হিরন বলছেন, “কোভিড সেরে যাওয়ার পরে যারা বাইরে যাবেন, বায়ু দূষণ তাদের ফুসফুসে অনেক বেশি ক্ষতি করবে। যাদের ফুসফুস কোভিডে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারা কোভিড থেকে সেরে ওঠার পর দূষিত বাতাসের সংস্পর্শে গেলে সর্দি, কাশি আরও বেড়ে যায়। ফুসফুসে সংক্রমণ বেড়ে গেলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।”
দূষণের কারণে নভেম্বর থেকে ফুসফুসের রোগগুলোতে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় বলে জানান জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক এই পরিচালক।
দ্য চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মির্জা মোহাম্মদ হিরন বলেন, “ফুসফুসের জন্য বায়ুদূষণ অনেক বেশি ক্ষতিকর। নিঃশ্বাসের সাথে দূষিত কণা আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে। সেগুলো অনেক জটিলতা তৈরি করতে পারে।”
তবে বায়ুদূষণের সঙ্গে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা কতটা বাড়তে পারে তা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বায়ুদূষণ হলে শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেড়ে যায়। তার উপর যদি করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হন, তাহলে জটিলতা বেড়ে যাবে।”
শীতে বৃষ্টি না হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে বাতাসের দূষণ কমার সুযোগ কমে যায়। আর ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নগরী হওয়ায় এখানকার বায়ুদূষণ অনেক বেশি উদ্বেগের বলে মনে করেন মুশতাক।
কেমব্রিজের পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই চিকিৎসক বলেন, “৫০ বছরের বেশি বয়সীরা, যাদের কোমরবিডিটি রয়েছে, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, উচ্চ রক্তচাপ, ওজনাধিক্য, ক্যান্সার ও কিডনির রোগী, ধুলাবালির কারণে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট হয়; তারা শীতে চাপে পড়বেন। যাদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত, বায়ুদূষণের ফলে তাদের ওপর বড় প্রভাব পড়বে।”
তাই দূষণের লাগাম টানতে সরকারকে প্রতিদিনই তৎপরতা চালানোর তাগিদ দিয়েছেন মুশতাক হোসেন।
“যানবাহনের কারণে এটা বেড়ে যায়। ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও কালো ধোয়া নির্গমনকারী যানবাহন সরিয়ে নিতে হবে। সিটি করপোরেশন দৈনিক দুই বার যদি রাস্তার দুই পাশে পানি ছিটায়, তাহলে দূষণ কমবে। নির্মাণ কাজ তো চলছেই, মাটি খোঁড়াখুড়ি যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়; তাহলে বায়ুদূষণ কমানো যাবে না।”
কোভিড-১৯ ও বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে তিনিও সাধারণ মানুষকে মাস্ক পড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
দূষণে লাগাম দেওয়ার তাগিদ
কোভিড পরিস্থিতিতে বায়ু দূষণকে জনস্বাস্থ্যের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন পরিবেশকর্মীরাও।
গত জুনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন- বাপার আয়োজিত এক ওয়েবিনারে ফিনল্যান্ডের সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার এর প্রধান গবেষক লরি মিলিভার্তা গবেষণাভিত্তিক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, বায়ুদূষণ করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যাকে বাড়িয়ে তুলছে এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতকে চাপের মধ্যে ফেলছে।
“বায়ুদূষণের ফলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যান্সারসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। নতুন মহামারি এসব রোগীর মৃত্যু শঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।”
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক অবশ্য দূষণ ঠেকাতে সরকারের ‘নানা ধরনের তৎপরতা’ চলার কথা জানিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত বছর আমরা ৭০০ ইটের ভাটা ভেঙে দিয়েছিলাম। এ বছরও ভেঙে দেওয়া হবে। আর আমরা ইটের পরিবর্তে ব্লককে উৎসাহিত করছি। কারণ ইটের ভাটায় ইট পোড়ানোর ফলেই দূষণটা হয়। এজন্য একটা প্রজ্ঞাপনও হয়ে গেছে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের সকল কাজে ইটের পরিবর্তে শতভাগ ব্লক ব্যবহার করা হবে।”
নির্মাণযজ্ঞের ধুলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হবে জানিয়ে জিয়াউল হক বলেন, “যেখানে নির্মাণকাজ চলবে, সেখানে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা হবে। অনেক সময় খোলা ট্রাকে ইট-বালি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, খোলা কোনো ট্রাক ঢাকায় ঢুকতে পারবে না। ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকতে হবে।
“নির্মাণ কাজ যেখানে চলছে, সেই সাইটও ঢেকে রাখতে হবে। তা না হলে আমরা ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে জরিমানা করব। যানবাহন থেকে যে দূষণ হচ্ছে, সেটা কমাতে ফিটনেসবিহীন কালো ধোঁয়া ছড়ানো গাড়িগুলো রাস্তা থেকে তুলে ফেলা হবে। এটা নিয়ে আমরা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও বিআরটিএ এর সাথে আলোচনা করছি।”